শিশু নির্যাতন ও সহিংসতা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ দরকার: বাংলাদেশ কী করতে পারে!
বদিউল আলম লিংকন: বাংলাদেশে শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ ও সহিংসতার ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি আমাদের সমাজের জন্য একটি গভীর উদ্বেগের বিষয়।
সম্প্রতি মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার জারিয়া গ্রামে আট বছরের শিশু আছিয়ার নির্মম মৃত্যু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, শিশুদের নিরাপত্তা কতটা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এই ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
শিশু নির্যাতনের বর্তমান চিত্র
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে ৪০১ জন নারী ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের ২০২৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারী ও শিশু নির্যাতনের ৬,৬৫৯টি মামলা হয়েছে।
এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, বাংলাদেশে শিশু ও নারী নির্যাতনের ঘটনা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আমাদের সমাজের জন্য মারাত্মক হুমকি।
নির্যাতনের প্রধান কারণসমূহ
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, সামাজিক সচেতনতার অভাব, মানসিক বিকৃতি এবং প্রযুক্তির অপব্যবহার শিশু নির্যাতনের মূল কারণ।
প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিচারহীনতার কারণে দেশে শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা বাড়ছে।
ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে ৯ জনই বাবা-মা, শিক্ষক বা অভিভাবকদের কাছ থেকে শারীরিক শাস্তি বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়।
এছাড়া, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারও শিশু নির্যাতনের একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে করণীয়
১. আইনের কঠোর প্রয়োগ
অপরাধীদের দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে অপরাধীরা ভয় পায় এবং এ ধরনের ঘটনা হ্রাস পায়।
২. সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি
পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজে শিশু সুরক্ষা নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
শিশুরা যাতে নির্ভয়ে তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কথা বলতে পারে, সে ধরনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
৩. শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ
শিশুদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখানো এবং যৌন শিক্ষা দেওয়া জরুরি, যাতে তারা বিপদ সম্পর্কে সচেতন হতে পারে।
৪. প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতকরণ
ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
পর্নোগ্রাফি ও অনলাইন হয়রানির সহজলভ্যতা নিয়ন্ত্রণে আনতে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিশ্বে শিশু নির্যাতন রোধে সফল উদ্যোগ
শিশু নির্যাতন একটি বৈশ্বিক সমস্যা। উন্নত দেশগুলো সফলভাবে বিভিন্ন মডেল বাস্তবায়ন করেছে, যা বাংলাদেশেও অনুসরণ করা যেতে পারে।
সুইডেন: Barnahus Model
১৯৭৯ সালে সুইডেন শিশুদের শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করে।
Barnahus Model অনুসারে, নির্যাতনের শিকার শিশুদের জন্য একক কেন্দ্রে মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা, আইনি সহায়তা ও চিকিৎসা প্রদান করা হয়।
ফলাফল: শিশু নির্যাতন কমেছে, অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে, শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত হয়েছে।
যুক্তরাজ্য: ‘Every Child Matters’ নীতি
২০০৩ সালে চালু হওয়া এই কর্মসূচির পাঁচটি মূল লক্ষ্য-
১. নিরাপদ থাকা
২. স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন
৩. সফলভাবে শেখা
৪. ইতিবাচক অবদান রাখা
৫. অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া
ফলাফল: শিশু নির্যাতন কমেছে, অভিভাবকদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র: AMBER Alert ও Megan’s Law
AMBER Alert: নিখোঁজ শিশুর তথ্য দ্রুত জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।
Megan’s Law: যৌন অপরাধীদের নাম ও তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়।
ফলাফল: শিশু অপহরণের ঘটনা দ্রুত সমাধান হয়, যৌন অপরাধীদের নজরদারিতে রাখা সহজ হয়।
জার্মানি: শিশু কল্যাণ কেন্দ্র (Kinderschutz-Zentren)
শিশুরা নির্যাতনের শিকার হলে এসব কেন্দ্রে গিয়ে সাহায্য নিতে পারে।
ফলাফল: শিশু নির্যাতনের অভিযোগ বাড়ছে, ফলে অপরাধীরা চিহ্নিত হচ্ছে, শিশুদের মানসিক সহায়তা ও আইনি পরামর্শ সহজলভ্য হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়া: ‘National Framework for Protecting Australia’s Children’
সরকার, এনজিও ও সমাজ একসঙ্গে শিশুদের সুরক্ষায় কাজ করে।
ফলাফল: যৌন সহিংসতা ও নির্যাতনের রিপোর্ট দ্রুত তদন্ত করা হয়, শিশুদের জন্য মানসিক সহায়তা সহজলভ্য হয়েছে
বাংলাদেশ কী করতে পারে?
বিশ্বের সফল মডেলগুলোর আলোকে বাংলাদেশেও নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে—শিশু সুরক্ষায় আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা, শিশুদের জন্য বিশেষ কল্যাণ কেন্দ্র চালু করা।
Barnahus Model অনুসরণ
১. শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ‘AMBER Alert’ জাতীয় ব্যবস্থা চালু করা ।
২. স্কুলে যৌন শিক্ষা ও আত্মরক্ষার কৌশল শেখানো।
৩. সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচার ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালানো।
শিশুরা আমাদের ভবিষ্যৎ। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব। শুধু আইন করলেই হবে না, এর কার্যকর বাস্তবায়নও নিশ্চিত করতে হবে।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও কঠোর আইন, সামাজিক সচেতনতা ও প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
প্রতিটি শিশুর নিরাপদ ভবিষ্যত নিশ্চিত করাই আমাদের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব।