সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: এক দূরদর্শী উদ্যোক্তার বিদায়
বদিউল আলম লিংকন: বাংলাদেশের অন্যতম খ্যাতিমান শিল্পপতি, এপেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী আজ বুধবার (১২ মার্চ) সিঙ্গাপুরের সময় সকাল ৭:৪৫ টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
তাঁর মৃত্যুতে দেশ হারালো এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বকে, যিনি বাংলাদেশে শিল্প ও ব্যবসায় খাতের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান এপেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এছাড়া, তিনি ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি) ও পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন।
জীবন ও শিক্ষা
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর জন্ম ১৯৪১ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর ভারতের কলকাতায়। তাঁর বাবা স্যার সৈয়দ নাসিম আলী ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রথম মুসলিম বিচারক এবং পরে অবিভক্ত বাংলার প্রধান বিচারপতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করে।
শিক্ষা জীবনে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্পন্ন করেন এবং পরে ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে থাকতেন এবং ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন।
কর্পোরেট ক্যারিয়ারের শুরু ও ব্যবসায়িক উদ্যোগ
১৯৬৫ সালে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী পাকিস্তান টোব্যাকো কোম্পানিতে ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি হিসেবে যোগ দেন। কর্পোরেট চাকরিতে বেশ সফলতা অর্জন করলেও তাঁর স্বপ্ন ছিল ব্যবসায়ী হওয়া।
১৯৭২ সালে তিনি চাকরি ছেড়ে নিজস্ব ব্যবসা শুরু করেন এবং চামড়া শিল্পের সাথে যুক্ত হন। ১৯৭৫ সালে সরকার চামড়া শিল্পকে বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত নিলে তিনি ওরিয়েন্ট ট্যানারি কিনে নেন এবং তার নাম পরিবর্তন করে এপেক্স ট্যানারি রাখেন।
পরবর্তীতে, ১৯৯০ সালে তিনি এপেক্স ফুটওয়্যার চালু করেন এবং ২০০০ সালে খুচরা বাজারে প্রবেশ করেন। তিনি চামড়া, পাদুকা, বীমা, ব্যাংকিং, ওষুধ, শিক্ষা, এবং বিজ্ঞাপনসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেন।
রাজনৈতিক ভূমিকা ও সামাজিক অবদান
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের একজন সম্মানিত নেতা ছিলেন। তিনি ঢাকা মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি, বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এছাড়া, তিনি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন।
১৯৯৬ ও ২০০১ সালে তিনি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করেন।
ব্যক্তিগত জীবন
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর স্ত্রী নিলুফার মঞ্জুর ছিলেন সানবীমস স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। ২০২০ সালে তিনি কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁদের পুত্র সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বর্তমানে এপেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
অর্জন ও পুরস্কার
ব্যবসা ও শিল্প খাতে অবদানের জন্য সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী বহু সম্মাননা পেয়েছেন। তিনি ২০০০ সালে “বিজনেস এক্সিকিউটিভ অফ দ্য ইয়ার” এবং ২০০২ সালে “বিজনেস পারসন অফ দ্য ইয়ার” পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর নেতৃত্বে এপেক্স গ্রুপ দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী ছিলেন এক দূরদর্শী নেতা, যিনি সততা, কঠোর পরিশ্রম এবং নিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশের শিল্প ও বাণিজ্যে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। তাঁর মৃত্যু বাংলাদেশের ব্যবসায়িক জগতে এক অপূরণীয় শূন্যতা সৃষ্টি করলো। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। আমিন।