ঢাকায় ছিনতাই রোধে বাড়তি নজরদারি প্রয়োজন: বিশেষজ্ঞ মতামত
টুইট ডেস্ক: রাজধানীর মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদী হাউজিং লিমিটেড এলাকায় তিনজনকে ছিনতাইকারী সন্দেহে আটক করে গণধোলাই দেওয়ার পর পুলিশের হাতে সোপর্দ করেছে স্থানীয় জনগণ। পরে তদন্তে একজনের বিরুদ্ধে ছিনতাইয়ের প্রমাণ পাওয়ায় তাকে অস্ত্রসহ আটক করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে পুলিশ।
ঘটনার বিবরণ
রোববার (২ মার্চ) রাত আনুমানিক ৯টার দিকে মোহাম্মদী হাউজিং এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওই সময় তিন ব্যক্তি সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করছিলেন। এক পর্যায়ে তারা এক পথচারীর কাছে গিয়ে মোবাইল ও টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। ভুক্তভোগীর চিৎকার শুনে স্থানীয়রা ছুটে এসে তাদের আটক করে।
এ সময় উত্তেজিত জনতা তাদের গণধোলাই দেয়। পরে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশকে খবর দেওয়া হলে তারা ঘটনাস্থলে এসে তিনজনকেই থানায় নিয়ে যায়।
পুলিশের বক্তব্য
মোহাম্মদপুর থানার সহকারী ডিউটি অফিসার এএসআই মনিরুল ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, “সাধারণ জনগণ ছিনতাইকারীদের ধরে আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে। তদন্তে একজনের বিরুদ্ধে ছিনতাইয়ের সম্পৃক্ততা পাওয়ায় তাকে আটক করা হয়েছে। তবে বাকি দুইজনের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট প্রমাণ না পাওয়ায় তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আটক ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।”
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সতর্কতা
রাজধানীতে ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাধারণ জনগণকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে। পাশাপাশি, সন্দেহজনক কোনো কার্যকলাপ দেখলে পুলিশকে দ্রুত অবহিত করার আহ্বান জানিয়েছে।
রাজধানী ঢাকায় সাম্প্রতিক সময়ে ছিনতাইয়ের ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পুলিশ ও অন্যান্য সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে ঢাকার ৫০টি থানায় ১২৫টি ছিনতাইয়ের মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই সময়ে ছিনতাইকারীদের হাতে একজন নিহত এবং বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হয়েছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের অপরাধ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সারা দেশে ডাকাতির মামলার সংখ্যা ১,২২৭ থেকে বেড়ে ১,৪১২-তে পৌঁছেছে। এছাড়া, ২০১৯ সাল থেকে ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত ছিনতাইয়ের ঘটনায় ৪৭,০০০-এর বেশি অভিযোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৯ সালে ৬,৮৮০টি, ২০২০ সালে ৭,২০০টি, ২০২১ সালে ৮,৪৯৮টি, ২০২২ সালে ৯,৫৯১টি, ২০২৩ সালে ৯,৪৭৫টি এবং ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত ৫,৮৮৩টি ঘটনা মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকায় ছিনতাই ও ডাকাতির মতো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তির সংখ্যা ছয় হাজারের বেশি। এর মধ্যে ১,৭৩৭ জন ছিনতাই এবং ৪,৪৬১ জন ডাকাতিতে জড়িত।
ঢাকায় ছিনতাইকারীদের ৪৩২টি হটস্পট চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে প্রায় ১,২০০ ছিনতাইকারী সক্রিয়। এছাড়া, নিয়মিত ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে এমন অন্তত ২৫টি স্পট চিহ্নিত করা হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিনতাই প্রতিরোধে বিশেষ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ঢাকা শহরসহ সারা দেশে রাত্রিকালীন টহল বাড়ানো, গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে চেকপোস্ট স্থাপন এবং অপরাধপ্রবণ হটস্পট চিহ্নিত করে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ছিনতাইয়ের ঘটনায় ভুক্তভোগীদের মধ্যে আতঙ্ক বৃদ্ধি পেয়েছে, যা নগরবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে।
নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত
রাজধানীতে ছিনতাই ও অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। মোহাম্মদপুরের সাম্প্রতিক ছিনতাইচেষ্টা ও গণধোলাইয়ের ঘটনার পর নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা কয়েকটি দিক তুলে ধরেছেন, যা নগরবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
আইনশৃঙ্খলা বিশ্লেষকদের মতামত
নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, “ঢাকার মতো ব্যস্ত শহরে অপরাধ প্রতিরোধে প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে সিসিটিভি ক্যামেরার সংখ্যা বৃদ্ধি, নিয়মিত টহল জোরদার এবং সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “ছিনতাইয়ের ঘটনা অনেক সময় সংগঠিত হওয়ার পর থানায় অভিযোগ করা হলেও অপরাধীদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে হাই-রেজোলিউশন সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হলে অপরাধীদের সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব হবে।”
সামাজিক সচেতনতা ও জনসচেতনতার গুরুত্ব
নিরাপত্তা গবেষক ড. আনিসুর রহমান মনে করেন, “ছিনতাই রোধে শুধু পুলিশি তৎপরতা যথেষ্ট নয়, নাগরিকদেরও সচেতন হতে হবে। রাতে কম আলোকিত বা নির্জন এলাকায় চলাচলের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা উচিত। পাশাপাশি, সন্দেহজনক কোনো কিছু দেখলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের হটলাইনে জানানো প্রয়োজন।”
তিনি আরও বলেন, “গণধোলাই কোনো সমস্যার সমাধান নয়, বরং এতে অনেক সময় নিরপরাধ ব্যক্তি শিকার হতে পারেন। তাই অপরাধীদের ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়াই সবচেয়ে যৌক্তিক ও আইনসম্মত উপায়।”
নগর পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা
নগর পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, “নগরীতে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে কেবল পুলিশি তৎপরতা নয়, বরং শহরের অবকাঠামোগত উন্নয়নও জরুরি। অপরাধপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করে সেখানে পর্যাপ্ত আলোকসজ্জা নিশ্চিত করা, খোলা জায়গায় পুলিশের উপস্থিতি বাড়ানো এবং পথচারীদের জন্য নিরাপদ করিডোর তৈরি করতে হবে।”
প্রস্তাবিত সমাধান
বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ করেছেন:
সিসিটিভি ক্যামেরার সংখ্যা বৃদ্ধি
গুরুত্বপূর্ণ মোড়, মার্কেট এলাকা এবং আবাসিক এলাকায় উন্নত প্রযুক্তির ক্যামেরা স্থাপন করা।
পুলিশ টহল জোরদার
বিশেষ করে সন্ধ্যা ও রাতের বেলায় নির্দিষ্ট ছিনতাইপ্রবণ এলাকায় পুলিশের উপস্থিতি বাড়ানো।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি
নাগরিকদের জন্য নিরাপত্তা বিষয়ে কর্মশালা ও প্রচারণা চালানো।
প্রযুক্তিনির্ভর নিরাপত্তা ব্যবস্থা
বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপে ‘সেফ সিটি’ রিপোর্টিং অপশন চালু করা, যাতে নাগরিকরা দ্রুত অপরাধের তথ্য দিতে পারেন।
কমিউনিটি পুলিশিং
স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণে নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করা।
নগরজীবনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি নাগরিকদেরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। অপরাধ প্রতিরোধে প্রযুক্তির ব্যবহার, জনসচেতনতা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে ছিনতাই ও অন্যান্য অপরাধ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।