কিছু ব্যাংকের বাঁচার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ: গভর্নর
টুইট ডেস্ক: বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দেশের ব্যাংকিং খাতে ক্রমাগত অবনতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, দেশের কিছু ব্যাংকের বাঁচার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ হয়ে পড়েছে।
সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও, পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর ঢাকায় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত দুই দিনের সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ‘অর্থনীতির পুনর্বিন্যাস বিষয়ে টাস্কফোর্সের সুপারিশ’ শীর্ষক সেশনে ‘ম্যাক্রো-ইকোনমিক পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স ইন দ্য ব্যাংকিং সেক্টর’-এ প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন গভর্নর।
গভর্নরের উদ্বেগের কারণ
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, “কিছু ব্যাংক এমন অর্থনৈতিক অবস্থায় পৌঁছেছে যেখানে তাদের টিকে থাকার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। সুশাসনের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, তবে সবগুলো ব্যাংককে হয়তো বাঁচানো সম্ভব হবে না।”
তিনি আরও বলেন, “কোনো কোনো ব্যাংকে ভয়াবহ অনিয়ম হয়েছে। যেমন—কোনো কোনো ব্যাংকের আমানতের ৮৭ শতাংশ একটি পরিবারের কাছে চলে গেছে। এর ফলে সেই ব্যাংকগুলোর টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।”
ডিজিটাল ব্যাংক ও এমএফএস (MFS) বিষয়ে সিদ্ধান্ত
গভর্নর জানান, নতুন কোনো ডিজিটাল ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই। বরং মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (MFS)-কে আরও কার্যকর ও আন্তঃলেনদেনযোগ্য করার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, “বর্তমানে আমাদের লক্ষ্য হলো বিদ্যমান ডিজিটাল সেবাগুলোকে আরও সহজলভ্য করা। নতুন কোনো ডিজিটাল ব্যাংক চালু করলে ব্যাংকিং সেক্টরের ওপর আরও চাপ বাড়বে।”
এফআইডি’র (আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ) ভূমিকা
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, “এফআইডি ব্যাংক খাতে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। তবে তারা বিমা খাতের বিষয়ে নজরদারি করতে পারবে।” তিনি আরও যোগ করেন, “ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হলে সরকারি হস্তক্ষেপ সীমিত করতে হবে।”
সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর অবস্থা
গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন যে, ইসলামী ব্যাংক ও ইউসিবিএল (United Commercial Bank Ltd.) বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লিকুইডিটি সাপোর্টের উপর নির্ভরশীল নয়। তিনি বলেন, “এই দুই ব্যাংক আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে সহায়তা নিলেও এখন নিজেরাই স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছে। তবে এখনও তাদের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কাঠামোতে বেশ কিছু সমস্যা রয়ে গেছে, যা উত্তরণের জন্য কাজ চলছে।”
তিনি আরও বলেন, “এ দুটি ব্যাংক এখনো বিপদমুক্ত নয়। তাদের কার্যক্রম পুরোপুরি স্বাভাবিক করতে হলে সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। তবে ইতিমধ্যেই তারা কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, যা ব্যাংকিং খাতের জন্য ইতিবাচক সংকেত।”
ব্যাংকিং খাতে অস্থিতিশীলতার কারণ
গভর্নর জানান, কয়েকটি ব্যাংকে একক পরিবার বা গোষ্ঠীর আধিপত্য এবং বিপুল অঙ্কের ঋণ দেওয়া ব্যাংকগুলোর আর্থিক সঙ্কটের বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, “একটি ব্যাংকের ৮৭ শতাংশ আমানত একটি পরিবারের হাতে চলে যাওয়া ব্যাংকিং খাতের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে এনেছে।”
এছাড়া, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, অযোগ্য পরিচালনা পর্ষদ ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণেও অনেক ব্যাংক আজ বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছে বলে গভর্নর মন্তব্য করেন।
প্রশাসনিক সংস্কারের উদ্যোগ
গভর্নর জানান, ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে—
সংকটাপন্ন ব্যাংকগুলোর পুনর্গঠন প্রক্রিয়া জোরদার করা।
ঋণ পুনঃতফসিল নীতিমালায় কঠোরতা আনা।
অযোগ্য পরিচালনা পর্ষদ ও ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ।
ব্যাংকের লিকুইডিটি ম্যানেজমেন্টের উপর কঠোর নজরদারি।
এমএফএস খাতকে আরও আধুনিক ও স্বচ্ছ করা।
সিপিডি সম্মেলনের মূল প্রস্তাবনা
সিপিডির সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞরা ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন।
তারা বলেন—”ব্যাংক খাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমাতে হবে।”
“বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে।”
“গ্রাহক সুরক্ষায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ জোরদার করতে হবে।”
গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর তাঁর বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক চেষ্টা করছে যেন দেশের ব্যাংকিং খাত ধ্বংসের দিকে না যায়। তবে সব ব্যাংককে বাঁচানো সম্ভব নাও হতে পারে। যেসব ব্যাংকে ভয়াবহ অনিয়ম হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে হয়তো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে রয়েছে। সঠিক নীতিমালা ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোতে বড় ধরণের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।