সেনাপ্রধানের হুঁশিয়ারি: কাদা ছোড়াছুড়ি করলে সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে

সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের গুরুত্বপূর্ণ বার্তা

টুইট ডেস্ক: ‘আমি আপনাদের সতর্ক করে দিচ্ছি, পরে বলবেন যে আমি সতর্ক করিনি। যদি নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে কাজ না করতে পারেন, যদি কাদা ছোড়াছুড়ি করেন, মারামারি-কাটাকাটি করেন, তাহলে এই দেশ এবং জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে।’

এভাবেই কঠোর বার্তা দিয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।

মঙ্গলবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর রাওয়া কনভেনশন হলে ২০০৯ সালের পিলখানা হত্যাকাণ্ড নিয়ে আয়োজিত বিশেষ অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান এ কথা বলেন। তিনি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য রাজনৈতিক অস্থিরতাকে দায়ী করে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান।

‘আমাদের নিজেদের ভুলে অরাজকতা তৈরি হচ্ছে’

সেনাপ্রধান বলেন, ‘দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার পেছনে প্রধান কারণ হলো আমাদের নিজেদের মধ্যে বিভাজন, পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদগার এবং সংঘাত। আমরা যদি সংঘবদ্ধ থাকি, তাহলে এসব মোকাবিলা করা সম্ভব।’

তিনি আরও বলেন, ‘অপরাধীরা জানে, বর্তমানে অরাজক পরিস্থিতির কারণে তারা সহজেই ফায়দা লুটতে পারে। তাই সংগঠিত থাকাটা অত্যন্ত জরুরি।’

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা ও চ্যালেঞ্জ

সেনাপ্রধান সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবদানের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই-এসব বাহিনী দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে বর্তমানে অনেক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা চলছে, অনেকে জেলে আছেন, যার ফলে বাহিনীগুলো কার্যকারিতা হারাচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই অপরাধীদের বিচার হোক, কিন্তু সেটা এমনভাবে করা উচিত যাতে বাহিনীগুলোর কার্যকারিতা নষ্ট না হয়। যদি এসব সংস্থা দুর্বল হয়ে যায়, তাহলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে।’

নির্বাচন প্রসঙ্গে সেনাপ্রধানের মতামত

সেনাপ্রধান উল্লেখ করেন, ‘আমরা দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন চাই। সরকার এ বিষয়ে কাজ করছে এবং বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সংস্কার গ্রহণ করা হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ড. মুহাম্মদ ইউনূসও এ বিষয়ে একমত যে, দেশে একটি স্বচ্ছ নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন, যা ডিসেম্বরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে পারে।’

দেশবাসীর প্রতি আহ্বান

সেনাপ্রধান দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের মধ্যে মতের পার্থক্য থাকতে পারে, চিন্তাধারার ভিন্নতা থাকতে পারে, কিন্তু দিনশেষে দেশের স্বার্থকে সবার আগে রাখতে হবে। যদি আমরা বিভক্ত থাকি, তাহলে দেশ আরও সমস্যার মধ্যে পড়বে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ চাই, যেখানে কোনো হানাহানি থাকবে না। সেনাবাহিনী জনগণের সেবায় কাজ করছে এবং জনগণের উচিত সেনাবাহিনীর প্রতি বিদ্বেষ না ছড়িয়ে তাদের সহযোগিতা করা।’

সেনাবাহিনীর প্রতি অনাস্থা নয়, সহযোগিতা প্রয়োজন

সামরিক বাহিনীর প্রতি কিছু মানুষের নেতিবাচক মনোভাবের সমালোচনা করে সেনাপ্রধান বলেন, ‘সেনাবাহিনী জনগণের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের আক্রমণ করবেন না, বরং আমাদের অনুপ্রাণিত করুন। আমরা পরামর্শ গ্রহণ করতে প্রস্তুত।’

সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্য দেশবাসীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। তিনি একতা ও সংহতির ওপর জোর দিয়েছেন এবং হুঁশিয়ার করেছেন যে, যদি দলাদলি ও কাদা ছোড়াছুড়ি চলতে থাকে, তাহলে দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়বে। সূত্র: সমকাল

বিশেষজ্ঞদের মতামত

সেনাপ্রধানের বক্তব্য বর্তমান রাজনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রতিচিত্র তুলে ধরেছে। তাঁর সতর্কবার্তা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতা রক্ষার ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ থাকা অপরিহার্য। তবে, সেনাবাহিনীর ভূমিকা এবং অন্যান্য বাহিনীগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ ইঙ্গিত দেয় যে, বর্তমান ব্যবস্থার মধ্যে কিছু দুর্বলতা রয়ে গেছে যা শিগগির সমাধান করা প্রয়োজন।

এছাড়া, নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে সেনাপ্রধানের বক্তব্য নতুন কিছু দিক উন্মোচন করেছে। তাঁর মতে, দেশকে একত্রিত রাখতে নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন জরুরি, যা আসন্ন সময়ে কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে।

তবে, সামরিক বাহিনীর প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ এবং বাহিনীগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে যেভাবে তিনি কথা বলেছেন, তা নিয়ে কিছু বিতর্ক তৈরি হতে পারে। কারণ, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সামরিক বাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকা সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ। তবে তি‌নি স‌ঠিক ও সত‌্য কথা তু‌লে ধ‌রে‌ছেন। বিদ্বেষ ছড়ানো মো‌টেও উচিৎ নয় এবং দে‌শের জনগণও মিথ‌্যা পছন্দ ক‌রে না।

সেনাপ্রধানের বক্তব্যের মূল বার্তা হলো জাতীয় ঐক্য ও স্থিতিশীলতা রক্ষা করা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা এবং রাজনৈতিক বিভক্তি এড়িয়ে দেশকে এগিয়ে নেওয়া।

এখন প্রশ্ন হলো, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ তাঁর সতর্কবার্তা কতটা গুরুত্বের সঙ্গে নেয় এবং বাস্তবে কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে।