ফারাক্কার বিরুপ প্রভাবে অচেনা রূপে পদ্মা
নিজস্ব প্রতিবেদক : সাড়ে চার থেকে পাঁচ দশক আগে কয়েক কিলোমিটার দূর থেকেও শোনা যেত খরস্রোতা প্রমত্তা পদ্মার তীব্র গর্জন। পদ্মার অববাহিকায় গড়ে উঠেছে এ অঞ্চলের সভ্যতা ও সংস্কৃতি। বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকারও অন্যতম আশ্রয়স্থল ছিল এ নদী। তবে পদ্মার সেই যৌবন আর নেই।
এখন পদ্মার বুকজুড়ে শুধু বালু আর বালু। ফলে অববাহিকায় কমেছে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ। বেড়েছে এ অঞ্চলের তাপমাত্রা। বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশও। ফারাক্কার প্রভাবে পদ্মা দেখে এখন মনে হয় এটি এখন মরুময় দেশের কোনো একটি অঞ্চল।
প্রতিবেশি দেশের নির্মিত ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে পদ্মা হারিয়েছে চিরচেনা রূপ। হারিয়েছে তার নিজস্ব জৌলুস। পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় কমেছে পদ্মার অর্ধেক আয়তন। কমেছে এর গভীরতাও। পদ্মায় পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে মৎস্য সম্পদ। আবাস স্থল হারিয়েছে দেশিয় প্রজাতির মাছ।
গবেষনা বলেছে, ১৯৮৪ সালের তুলনায় পদ্মা নদীর আয়তন কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। পানির গভীরতা কমেছে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রবাহ কমেছে ২৬ দশমিক ২ শতাংশ। ফলে পানি প্রবাহ কমার কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলে নেমে গেছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। বর্তমানে রাজশাহী অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ১২৫ ফুট নিচে অবস্থান করছে।
পানিপ্রবাহ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে প্রতিবেশি দেশ ভারত পদ্মার ১৮ কিলোমিটার উজানে ফারাক্কা বাঁধ চালু করে ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল। এ বাঁধ দিয়েই ভারত পশ্চিমবঙ্গের ভাগিরথী ও হুগলি নদীতে পানি প্রত্যাহার শুরু করে।
গবেষকদের মতে, ফারাক্কার প্রভাবে মিঠা পানির সরবরাহ কমেছে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত। এছাড়া পদ্মা অববাহিকায় বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১৯ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। অববাহিকায় বেড়েছে তাপমাত্রা। ১৯৮১ সালে রাজশাহী অঞ্চলের গড় তাপমাত্রা ছিল ২৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০১৯ সালে সেটি বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ২৬ দশমিক ২ ডিগ্রি।
মূলত পদ্মার প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য শুকনো মৌসুমকে বেছে নেন গবেষকরা। এ সংক্রান্ত গবেষক দলের সদস্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শামস মুহা. গালিব বলেন, ওই প্রবন্ধে আমরা ১৯৮২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পদ্মার হাইড্রোলজিক্যাল, জলবায়ু ও নৃতাত্ত্বিক পরিবর্তনের সঙ্গে মৎস্য প্রজাতির সম্পর্কের প্রক্রিয়া অনুসন্ধান করেছি। তাতে পদ্মার আয়তন অর্ধেক কমে যাওয়ার তথ্য বের হয়ে আসে। জীববৈচিত্র্যে বিরূপ প্রভাবের কারণে এ অঞ্চলের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এসেছে। পদ্মায় এখন আর তেমন ইলিশ পাওয়া যায় না। ফারাক্কা চালুর আগে পদ্মায় ইলিশসহ সব প্রজাতির মাছ ছিল সুলভ। পদ্মা অববাহিকতার হাজার হাজার জেলে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। মাছ না পাওয়ায় গত ৫ দশকে জেলেদের ৪ ভাগের ৩ ভাগই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।
জানা যায়, রাজশাহীর উজানে গোদাগাড়ী থেকে ভাটিতে চারঘাটের সরদহ পর্যন্ত পদ্মার ৭০ কিলোমিটার অংশ নিয়ে গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে। ওই এলাকার নয়টি পয়েন্টে মৎস্য প্রজাতির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পদ্মা পারের ২৭টি জেলেপল্লি থেকে নেওয়া হয় জীবন-জীবিকার তথ্য। স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে পদ্মার বর্তমান চিত্র তুলে আনার চেষ্টা করা হয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. ইয়ামিন হোসাইন বলেন, পদ্মায় এখন আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। শুশুক ও ঘড়িয়ালের যে একটা বড় প্রজনন ক্ষেত্র ছিল তা এখন আর নেই বললেই চলে। আগে পদ্মায় বড় ইলিশ পাওয়া যেত। এখন কিছু ইলিশ মিললেও আকারে ছোট।
সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা ওয়ালি উল্লাহ মোল্লাহ জানান, ইলিশ ভাটি থেকে উজানে আসে। পদ্মায় পানির গভীরতা কমেছে, পানির ফিল্টারেশন কমে গেছে। ফলে পদ্মার পানি ঘোলা থাকে। ফলে ইলিশ এলেও বেশি সময় অবস্থান করে না। পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে ভারত পদ্মার ১৮ কিলোমিটার উজানে ফারাক্কা বাঁধ চালু করে ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল। এ বাঁধ দিয়েই ভারত পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথি ও হুগলি নদীতে পানি প্রত্যাহার শুরু করে। সেই থেকে ভাটিতে পদ্মার ভয়ানক দুরবস্থা চলছে।
গবেষকরা জানান, বাঁধ চালুর আগে ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত পদ্মায় প্রতি সেকেন্ডে পানি প্রবাহ ছিল ৯ হাজার ৩২ ঘনমিটার। বাঁধ চালুর পর ১৯৭৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রবাহ নেমেছে ৫ হাজার ১৪৬ ঘনমিটারে। বছরের ৬ মাসই পানি থাকে না প্রায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৭ সালে ভারতের সঙ্গে প্রথম গঙ্গার পানি চুক্তি সই হয়। সঙ্গে যুক্ত ছিল গ্যারান্টি ক্লজ। সামরিক সরকার এরশাদের আমলে এ চুক্তি দুবার নবায়ন হয়। ১৯৮২ সালে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে একই বছর সমঝোতা স্মারক সই হয়। তবে বাদ দেওয়া হয় গ্যারান্টি ক্লজ। যেখানে ছিল বাংলাদেশের হিস্যার ৮০ শতাংশ পানি পাওয়ার নিশ্চয়তা।
সবশেষ ১৯৯৬ সালে ৩০ বছর মেয়াদি যে গঙ্গা চুক্তি করা হয়, তাতেও রাখা হয়নি গ্যারান্টি ক্লজ। চুক্তি অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ১০ দিন পরপর ৩৫ হাজার কিউসেক পানি উভয় দেশ পাবে। ফারাক্কা বাঁধ চালু হওয়ার পর শুকনো মৌসুমে পদ্মার প্রবাহ কমে দাঁড়িয়েছে প্রতি সেকেন্ডে ২ হাজার ৩৩ ঘনমিটারে। বাঁধ চালুর আগে শুকনো মৌসুমে পদ্মায় প্রবাহ ছিল ৩ হাজার ৬৮৫ ঘনমিটার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্ষাকালেও প্রবাহ কমেছে পদ্মায়। ফারাক্কা চালুর আগে বর্ষায় পানির গড় প্রবাহ ছিল সেকেন্ডে ১২ হাজার ১১৫ ঘনমিটার। বর্তমানে এ প্রবাহ নেমে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৮২৭ ঘনমিটারে। এটা কমছেই।
গবেষকরা আরও জানান, ১৯৮০ সালে পদ্মা অববাহিকায় দৈনিক গড় বৃষ্টিপাত ছিল ৫ দশমিক ২ মিলিমিটার। ২০১৯ সালে এসে দৈনিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ দশমিক ২ মিলিমিটারে। গত ৩০ বছরে বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পঞ্চাশ থেকে ষাট ফুট নিচে নেমে গেছে।
রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুর রহমান অঙ্কুর বলেন, ১৯৯৬ সালে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা চুক্তি অনুযায়ী জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ১০ দিন পরপর ৩৫ হাজার কিউসেক পানি উভয় দেশ পাবে। অর্থাৎ ১০ দিন পর পর ভারত পশ্চিমবঙ্গের ভাগিরথী ও হুগলি নদীতে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহার করছে। সেটি যদি না করা হতো তা হলে সম্পন্ন পানি পদ্মায় প্রবাহিত হত। ফলে পদ্মার এমন চিত্র হতো না।
তিনি বলেন, রাজশাহীতে বন্যাকালীন পদ্মায় পানির উচ্চতা ১৮ দশমিক ৫০ মিটার। তবে নভেম্বরে পদ্মায় পানির উচ্চতা ছিল ৭ দশমিক ৬ মিটার। ডিসেম্বরে উচ্চতা ছিল ৫ দশমিক ৩৭ মিটার এবং সর্বশেষ জানুয়ারিতে পদ্মার পানির উচ্চতা পরিমাপ করা হয় ৪ দশমিক ৫৫ মিটার।
এদিকে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের (জিআরসি) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী ১ থেকে ১০ জানুয়ারি সময়ে ফারাক্কা পয়েন্টে পানির পরিমাণ ছিল ৯৬ হাজার ৭০০ কিউসেক। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রাপ্যতা ছিল ৫৬ হাজার কিউসেক। তবে এই সময়ে বাংলাদেশ পেয়েছে ৪০ হাজার কিউসেক। ২১ থেকে ৩১ জানুয়ারি সময়ে ফারাক্কায় পানি ছিল ৯২ হাজার ৫৬২ কিউসেক। এ সময়ে বাংলাদেশ পেয়েছে ৪০ হাজার কিউসেক। আগামী ৪ মাসে বাংলাদেশে পানি আরও কমবে।
বিশিষ্ট নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী আরও বলেন, ভারত আন্তর্জাতিক নিয়মের তোয়াক্কা না করে উৎস ও উজানে গঙ্গার ওপর অসংখ্য বাঁধ প্রকল্প নির্মাণ করে পানি নিজেদের দিকে সরিয়ে নিচ্ছে। এর ফলে ফারাক্কা পয়েন্টে যথেষ্ট পানি পৌঁছাতে পারছে না। ভারতের এসব প্রাণঘাতী প্রকল্প অপসারণ করা ছাড়া গঙ্গা-পদ্মায় স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনার অন্য কোনো বিকল্প নেই।
রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, গঙ্গা চুক্তি শেষ হবে ২০২৬ সালে। এই চুক্তির আগামীতে কী হবে সেটি নিয়ে আমরা অন্ধকারে রয়েছি। পানি ছাড়া এই অঞ্চল মরুভূমি হয়ে যাবে। পানিই যদি না থাকে, তাহলে কিসের উন্নয়ন। পদ্মা নদী শুকিয়ে গেছে। এই পদ্মা নদীকে বাঁচাতে হলে খনন করতে হবে।