নওগাঁয় ৬০০ কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা “বন্ধু মিতালি ফাউন্ডেশন”

প্রতারিত হাজারো গ্রাহক

টুইট ডেস্ক: নওগাঁর আর্থিক জালিয়াতি কেলেঙ্কারির নতুন অধ্যায়ে যুক্ত হয়েছে বন্ধু মিতালি ফাউন্ডেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নাজিম উদ্দিন তনুসহ কর্ণধাররা প্রায় ৬০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে গেছেন।

ভুক্তভোগী গ্রাহকরা দফায় দফায় মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করলেও এখন পর্যন্ত তাদের টাকা ফেরতের কোনো নিশ্চয়তা মেলেনি।

জেলার মান্দা উপজেলার দক্ষিণ মইনুম গ্রামের বাসিন্দা জাহানারা বেগম তার মেয়ের বিয়ের জন্য জমি বিক্রি করে আড়াই লাখ টাকা বন্ধু মিতালি ফাউন্ডেশনে রেখেছিলেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, “ভালো থাকার আশায় টাকা রেখেছিলাম, এখন একদম নিঃস্ব হয়ে গেছি।”

রানীনগরের বেদগাড়ী ভবানীপুর গ্রামের এক গ্রাহক জানান, তার দুই ছেলে বিদেশে কর্মরত। তারা ৬০ লাখ টাকা দেশে পাঠিয়ে এই সমিতিতে রেখেছিলেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের মালিকরা টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ায় তিনি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।

এছাড়াও, নওগাঁ শহরের মাস্টারপাড়া এলাকার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জাহিদুল ইসলাম তার পেনশনের ১০ লাখ টাকা বন্ধু মিতালি ফাউন্ডেশনে বিনিয়োগ করেছিলেন। শুরুতে লাভ দিলেও পরে টাকা প্রদান বন্ধ হয়ে যায়। তিনি বলেন, “সরল বিশ্বাসে টাকা রেখেছিলাম, এখন সব হারিয়ে দিশেহারা।”

প্রতিষ্ঠানটি কীভাবে প্রতারণা চালাতো?

২০০৯ সালে নাজিম উদ্দিন তনু বন্ধু মিতালি ফাউন্ডেশন চালু করেন। এটি সমবায় অধিদপ্তর ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের কোনো নিবন্ধন ছাড়াই কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল। প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ ব্যাংকের তুলনায় বেশি মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করে।

প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংকের আদলে মাসিক ও বার্ষিক আমানত প্রকল্প, স্থায়ী বিনিয়োগ, ও স্থায়ী আমানতের ব্যবস্থা চালু করেছিল। গ্রাহকদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, প্রতি লাখে দুই হাজার টাকা লাভ প্রদান করা হবে। প্রথম দিকে লাভের টাকা প্রদান করা হলেও পরে তা বন্ধ হয়ে যায় এবং ২০২4 সালের নভেম্বর মাসে এমডি নাজিম উদ্দিন তনু ও তার সহযোগীরা আত্মগোপন করেন।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে প্রশাসন অভিযানে নামে। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মামুনুর রশিদ মামুন, তার স্ত্রী, ভাগনি জামাই এবং নাজিম উদ্দিন তনুর বোন সুফাকে আটক করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর সহায়তায় মামুনুর রশিদকে নওগাঁ সদর থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

জেলা সমবায় কর্মকর্তা খন্দকার মনিরুল ইসলাম বলেন, “এই প্রতিষ্ঠান কোনো নিবন্ধিত সংস্থা নয়, এটি অবৈধভাবে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। আমরা যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছি।”

নওগাঁর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গাজিউর রহমান বলেন, “ভুক্তভোগীদের করা মামলার ভিত্তিতে আমরা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি। গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে মূল হোতাদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।”

জেলা প্রশাসক আবদুল আউয়াল জানান, “প্রতিষ্ঠানটির নামে থাকা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার বিষয়টি আদালতে উপস্থাপন করা হবে, যাতে গ্রাহকরা তাদের সঞ্চিত টাকা ফেরত পেতে পারেন।”

নওগাঁসহ সারা দেশে এ ধরনের প্রতারণার ঘটনা বারবার ঘটছে। গত বছর প্রায় ৮-১০টি সমবায় সমিতি হাজার কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সাধারণ মানুষকে উচ্চ মুনাফার লোভ থেকে সতর্ক থাকতে হবে। পাশাপাশি, প্রশাসনকে এ ধরনের সংস্থার কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ প্রতারণার শিকার না হন।