‘মার্চ টু ঢাকা’ ঠেকাতে হাসিনা সরকারের পরিকল্পনা কি ছিল

টুইট ডেস্ক: ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঠেকানোর লক্ষ্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৪ আগস্ট দুই ধাপে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, এই বৈঠকে সেনা, বিমান, নৌ, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই, পুলিশ ও পুলিশের বিশেষ শাখার প্রধানসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা অংশ নেন। বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন।

প্রথম বৈঠকে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের অধীনে আলোচনা করা হয়, যেখানে ‘মার্চ টু ঢাকা’ প্রতিরোধের জন্য কঠোর কারফিউ জারি ও তা বলবৎ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। একই দিন সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে (গণভবন) অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বৈঠকে সেনাপ্রধানসহ অন্যান্য নিরাপত্তা কর্মকর্তারা ঢাকা রক্ষার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেন। বৈঠকে একটি ঐক্যমত দেখা যায়, যে—প্রয়োজনে শক্তি ব্যবহার করে ঢাকার কেন্দ্রস্থলে প্রবেশের পথে বাধা দিতে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশের সমন্বয়ে মোতায়েন ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সূত্র: জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের দপ্তর (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধানী প্রতিবেদন (১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)

শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনী, স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের তৎকালীন মহাপরিচালক ৫ আগস্ট প্রহরে (রাত ১২:৫৫) বিজিবির মহাপরিচালককে দুটি হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা প্রেরণ করেন। ওএইচসিএইচআর কর্তৃক প্রাপ্ত হার্ড কপি অনুযায়ী, প্রথম বার্তায় আন্দোলনের নেতাদের ঢাকার প্রবেশপথ সম্পর্কে তথ্য প্রদান করা হয়, আর দ্বিতীয় বার্তায় প্রতিরক্ষা আদেশের রূপরেখা—প্রথম ও দ্বিতীয় লাইন, তৃতীয় দূরপাল্লার ইউনিট, ব্যাকআপ ইউনিট ও পশ্চাদ্ভাগের বাহিনীর উল্লেখ রয়েছে।

তবে, ৫ আগস্ট সকালে সেনাবাহিনী ও বিজিবি সদস্যরা পরিকল্পিত মোতায়েন অনুসারে কার্যক্রম সম্পাদন করেননি। একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার সাক্ষ্যে জানা যায়, সেনাবাহিনী যে বাহিনী মোতায়েনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা বাস্তবে মোতায়েন করেনি; আবার অন্য কর্মকর্তাদের মতে, বিজিবি প্রতি ঘণ্টায় বিভিন্ন প্রবেশপথ দিয়ে ১০,০০০ থেকে ১৫,০০০ বিক্ষোভকারী ঢুকতে দিয়েছে, যা তাদের নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা ছিল।

যখন ৫ আগস্ট সকালে বিক্ষোভকারীদের ঢাকার কেন্দ্রে প্রবেশ রোধে পুলিশের নানা জায়গায় প্রাণঘাতী গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়, তখন পরিস্থিতি আক্রমণাত্মক মোডে ঢলে পড়ে।
– চানখাঁরপুলে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের কর্মকর্তারা রাইফেল থেকে প্রাণঘাতী গুলি চালায়,
– শাহবাগের দিকে অগ্রসর বিক্ষোভকারীদের থামাতে কম প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহৃত হলেও,
– রামপুরা ব্রিজ পার হয়ে বাড্ডায় যাওয়ার সময় পুলিশ ধাতব গুলি ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে, যার ফলে অনেকেই আহত হন।

প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, আজমপুরে ১২ বছর বয়সী এক বালক সহ নানা বিক্ষোভকারীর ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর অপ্রয়োজনীয় গুলির আঘাত পড়ে; এক ছেলের ক্ষেত্রে শটগানের পেলেট খুব কাছ থেকে গুলি করার কারণে মারাত্মক আঘাত লেগেছিল।
এছাড়াও, সাভার বাসস্ট্যান্ডের আশেপাশে পুলিশের বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর ঘটনায় বিপুলসংখ্যক হতাহত হওয়ার তথ্য এসেছে।
একইসাথে, একটি রিকশাচালককে পুলিশের কাছে আটক করে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করার ঘটনা গাজীপুরে সংঘটিত হয়।

নিবন্ধিত সকল তথ্য ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বোঝা যায়, ‘মার্চ টু ঢাকা’ ঠেকাতে সরকারী পরিকল্পনা গ্রহণের সত্ত্বেও মাঠে নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যর্থতা ও নিরাপত্তা বাহিনীর নির্দেশিত শাসন রক্ষায় অপর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে ব্যাপক জনহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটানো হয়।

সরকারের পক্ষ থেকে আন্দোলনকারীদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যায়িত করে কঠোর কারফিউ জারি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও, বাস্তবে তা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি।