টাকার নেশায় অমানুষ হয়ে যাওয়া এক প্রজন্ম

০৭অতি উৎসাহী প্রশাসন ও স্বার্থসিদ্ধির খেলায় রাষ্ট্রের বিপর্যয়

ব‌দিউল আলম লিংকন: শাসক পরিবর্তন হলেও অনেক সময় প্রশাসনের আচরণ অপরিবর্তিত থেকে যায়। রাষ্ট্রের ক্ষমতা যার হাতে থাকে, তার প্রতি প্রশাসনের আনুগত্য থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু যখন এই আনুগত্য সীমাহীন তোষামোদি ও স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তখন তা জনস্বার্থের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়।

বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোতে গত এক যুগে এমন এক শ্রেণির কর্মকর্তার উত্থান হয়েছে, যারা ক্ষমতাসীনদের মন রক্ষা করতে গিয়ে আইনের শাসন ও নৈতিকতা ভুলে গেছেন।

শেখ হাসিনার সরকারের সময় একদল অতি উৎসাহী প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য বিরোধী মত দমন, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অবৈধভাবে সম্পদ আহরণের কাজে লিপ্ত হয়েছিলেন।

তারা বুঝতে পেরেছিলেন, সরকারি সুবিধা, পদোন্নতি ও অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য পেতে হলে ক্ষমতাসীনদের অন্ধ সমর্থক হতে হবে। ফলে তারা সংবিধান ও আইন ভুলে গিয়ে গুম, খুন, নির্যাতন, দুর্নীতিকে একপ্রকার নিয়মে পরিণত করেছিলেন।

একটি জনপ্রিয় প্রবচন আছে—“কলা গাছ রোপণ করলে একবারই ফল দেয়, কিন্তু এরা কলা গাছকে বানিয়েছে টাকার গাছ, যা তাদের বারবার লোভী করে তুলেছে।”

অতি উৎসাহী প্রশাসনিক কর্মকর্তারা সরকারের ছত্রছায়ায় নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়েছেন। একদিকে তারা রাজনৈতিক নেতাদের সন্তুষ্ট করেছেন, অন্যদিকে নিজেরাও কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছেন।

লোভের চক্রে—পদোন্নতি পাওয়ার জন্য গুম, খুন, হয়রানি, মামলার মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে।

সরকারি প্রকল্প, উন্নয়ন কাজ, বিদেশি ঋণ এবং অনুদানের বড় অংশ আত্মসাৎ করা হয়েছে।

ব্যবসায়ীদের উপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে কমিশন খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে।

জমি দখল, ব্যাংক লুটপাট ও কালো টাকার বৈধীকরণে প্রশাসনের একটি বড় অংশ প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছে।

এভাবে অতি উৎসাহীদের দলীয় আনুগত্যের কারণে দেশের সাধারণ জনগণ ন্যায়বিচার ও স্বচ্ছ প্রশাসন থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

টাকার মোহ মানুষের বিবেককে ধ্বংস করে দিতে পারে—বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোতে সেটাই দেখা গেছে। একসময় যারা জাতির সেবক হওয়ার শপথ নিয়েছিলেন, তারাই আজ ক্ষমতার মোহে অমানুষে পরিণত হয়েছেন।

মানুষের চিৎকার, বিচারপ্রার্থীদের আহাজারি, গুম হওয়া পরিবারগুলোর কান্না তাদের স্পর্শ করে না। টাকা তাদের এতটাই অন্ধ করেছে যে, তারা নিজেদের সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়েও প্রশ্ন করেন না—আমরা ঠিক কাজ করছি কি না?

বিদেশে সম্পদ, ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা, বিলাসবহুল জীবনযাপন তাদের মানবিকতাকে মুছে দিয়েছে।

জনগণের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার। একটা সমাজ কতটা অধঃপতনে গেলে আইন-শৃঙ্খলার রক্ষকরা স্বার্থসিদ্ধির জন্য অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়? প্রশ্ন হচ্ছে—এত অন্যায় যারা করেছে, তারা কি পার পেয়ে যাবে? লিখ‌তেও ম‌নে কষ্ট হ‌চ্ছে।

এখন সময় এসেছে প্রশাসনের এই দুর্নীতিবাজ ও অমানবিক অংশের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার।

যারা গুম-খুনের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব জনগণের সামনে প্রকাশ করতে হবে।

জনগণের টাকায় বিলাসী জীবনযাপন করা এসব লুটেরাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
শুধু সরকার পরিবর্তন হলে চলবে না, রাষ্ট্রের প্রশাসনিক নৈতিকতা ফিরিয়ে আনতে হবে। তা না হলে, যে অন্যায় একবার হয়েছে, তা আবারও ঘটবে—শুধু চরিত্রগুলো বদলাবে।

জনগণের প্রশ্ন—গণতন্ত্রের নামে আমরা কি অতি উৎসাহী লুটেরাদের দাসত্বই করতে থাকব, নাকি তাদের শাস্তি দেখে ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা করব?