আয়নাঘর: গুম ও নির্যাতনের ভয়াবহ সত্য প্রকাশ্যে

“আয়নাঘর পরিদর্শনে গিয়ে আসিফ দেখালেন কোথায় রাখা হয়েছিল তাকে”

টুইট ডেস্ক: গুম, নির্যাতন ও অবর্ণনীয় নিপীড়নের মাধ্যমে ভিন্নমত দমন করার জন্য গোপন এই বন্দিশালাগুলোর ব্যবহার নিয়ে দেশি-বিদেশি মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।

বুধবার (১২ ফ্রেবুয়ারি ২০২৫) প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমকর্মী ও ভুক্তভোগীদের নিয়ে আয়নাঘর পরিদর্শনে যান, যেখানে তিনি চক্ষুচড়কগাছ করা তথ্য জানতে পারেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আইয়ামে জাহেলিয়াত প্রতিষ্ঠা করে গেছে আওয়ামী লীগ সরকার। বুধবার গুমের আয়নাঘর পরিদর্শনে তিনি একথা বলেন।

ভুক্তভোগীদের বর্ণনায় আয়নাঘর

জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে তুলে নেওয়ার পর ডিজিএফআই টর্চারসেলে (আয়নাঘর) আটকে রাখা হয়েছিল।

গত জুলাইয়ে গণঅভ্যুত্থানের সময় ডিজিএফআই-এর সদস্যরা সাদা পোশাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে। পরে তাকে রাখা হয় এক গোপন টর্চার সেলে, যা পরবর্তীতে ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত হয়।

১২ ফেব্রুয়ারি আয়নাঘর পরিদর্শনকালে তিনি সেই কক্ষটি চিনতে পারেন। ফেসবুক পোস্টে তিনি উল্লেখ করেন, নির্যাতন কক্ষের দেয়ালের ওপরে এক্সস্ট ফ্যানের খোপ ছিল, যা শব্দ বাইরে যেতে বাধা দিত।

প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস এই বন্দিশালাগুলোর ভয়াবহতা দেখে হতভম্ব হয়ে পড়েন।

তিনি বলেন, “এ রকম ইন্টারোগেশন সেল, টর্চার সেল সারা বাংলাদেশজুড়ে আছে; সেগুলো শুনলাম আজকে। আমার ধারণা ছিল যে, এখানে আয়নাঘর বলতে যে কয়েকটা আছে তাই। কিন্তু এখন শুনলাম, আয়নাঘরের ভার্সন সারা দেশজুড়ে আছে। কেউ বলছে ৭০০, কেউ বলছে ৮০০। সংখ্যাও নিরূপণ করা যায়নি। কতটা জানা আছে, কতটা অজানা রয়ে গেছে।”

তিনি আরও বলেন, “নৃশংস অবস্থা। প্রতিটি জিনিস যে হয়েছে এখানে, যতটাই শুনি অবিশ্বাস্য মনে হয়। এটা কি আমাদেরই জগত, আমাদেরই সমাজ। আমরা কি এটা করলাম? যারা নিগৃহীত হয়েছে, যারা এটার শিকার হয়েছে তারাও আমাদের সঙ্গে আছে। তাদের মুখ থেকে শুনলাম—এটা কীভাবে হয়েছে।”

প্রধান উপদেষ্টা সাবেক সরকারের কর্মকাণ্ডকে তুলনা করেছেন ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’-এর সঙ্গে।

গুম ও নির্যাতনের ভয়াবহ পরিসংখ্যান

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে গুম ও নির্যাতনের পরিসংখ্যান ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে।

তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬০৫ জনকে গোপনে বন্দি রাখা হয়েছিল।

২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশে ৩৪৪ জন গুম হন, যাদের মধ্যে ৪০ জনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় এবং ৬৬ জনকে সরকারি হেফাজতে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

গুমের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে অধ্যাপক মোবাশার হাসান, সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান, ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ কুমার রায়, মাইকেল চাকমা ও মীর আহমদ বিন কাসেমের মতো পরিচিত নামও রয়েছে।

আয়নাঘরের ভয়াবহতা: ফিরে আসাদের বয়ান অনেক গুম হওয়া ব্যক্তি শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আয়নাঘর থেকে ফিরে আসেন। তাদের ভাষ্যমতে, আয়নাঘরে বন্দিদের ওপর চালানো হতো পৈশাচিক নির্যাতন—ঘণ্টার পর ঘণ্টা চোখ বাঁধা রেখে বসিয়ে রাখা হতো।

ইলেকট্রিক শক ও পানির মধ্যে ডুবিয়ে শ্বাসরোধের মতো নির্যাতন চালানো হতো।
মনস্তাত্ত্বিক অত্যাচার করা হতো যাতে তারা স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য হয়।

সাবেক বন্দিরা জানিয়েছেন, আয়নাঘরে ঢোকার পর তারা নিজেদের জীবিত ফিরে আসার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। সুইডেনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নেত্র নিউজ প্রথমবার আয়নাঘরের অস্তিত্ব প্রকাশ্যে আনে।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার কীভাবে হতে পারে?

বর্তমান সরকার আয়নাঘরের ভয়াবহতাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করছে। ইতোমধ্যে গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন গঠিত হয়েছে, যারা এসব অপরাধের যথাযথ তদন্ত করছে।

বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলেছে,

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে তদন্তের সুযোগ দেওয়া হবে।

গুম ও নির্যাতনে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার করা হবে।
ভুক্তভোগীদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংস্কার করে অতীতের অন্যায় প্রতিরোধ করা হবে।

‘আয়নাঘর’ শুধু একটি বন্দিশালার নাম নয়; এটি বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক ভয়াবহ নিদর্শন। স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার কেড়ে নেওয়া, গুম-নির্যাতনের মাধ্যমে ভীতি সৃষ্টি করার যে নীতি অনুসরণ করা হয়েছিল, তা আজ আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত। বর্তমান সরকার ও বিশ্ব সম্প্রদায় এই অপরাধের বিচার নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর।

বিচারের দাবিতে বিশ্ব মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করা জরুরি!