ব্যাংকার থেকে দুর্নীতির বরপুত্র: চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের উত্থান ও পতন
চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের উত্থান, ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও সম্পদের পাহাড়
অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে
মোট পরিমাণ হলো ১,৬৮৭ কোটি টাকা।
টুইট ডেস্ক: বাংলাদেশের আর্থিক খাতে যারা দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন, তাদের মধ্যে চৌধুরী নাফিজ সরাফাত এক আলোচিত নাম। সাধারণ ব্যাংক কর্মকর্তা থেকে রাতারাতি প্রভাবশালী হয়ে ওঠার পেছনে ছিল রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির এক জটিল চক্র।
গোপালগঞ্জের বাসিন্দা চৌধুরী নাফিজ সরাফাত তার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন ১৯৯৯ সালে, বিদেশি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের একজন সাধারণ কর্মকর্তা হিসেবে। তবে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে যখন তিনি ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সালমান এফ রহমানের ঘনিষ্ঠ হন।
এই পরিচয়ের সুবাদে নাফিজ সরাফাত আইএফআইসি ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক নিযুক্ত হন, যদিও তখনও তিনি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে চাকরিতে ছিলেন। এই অনৈতিক দ্বৈত ভূমিকার মাধ্যমেই তিনি আলোচনায় আসেন।
২০০৮ সালে তিনি কনজ্যুমার ব্যাংকিংয়ের প্রধান হিসেবে যোগ দেন আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে, যেখানে থেকে তিনি শেয়ারবাজারের কারসাজিতে যুক্ত হন।
২০০৯-২০১৯ সময়কালে সরাফাতের উত্থান হয় অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। সে সময়ের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের আশীর্বাদে তিনি দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের কাতারে চলে আসেন। তার সম্পর্কে বলা হতো, শেখ হাসিনাকে তিনি “পাতানো ফুফু” এবং অর্থমন্ত্রী লোটাস কামালকে “পাতানো চাচা” বলে ডাকতেন।
২০১৮ সালে নাফিজ সরাফাতকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ফার্মার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান করা হয়, যা পরে “পদ্মা ব্যাংক” নামে পরিচিতি পায়। দুর্নীতির কারণে প্রায় দেউলিয়া হওয়া ব্যাংকটি পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সরাফাতকে, কিন্তু তিনি ব্যাংকটির অর্থ লোপাট করে নিজের সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন।
শুধু ব্যাংক খাতেই নয়, নাফিজ সরাফাতের নাম উঠে আসে শেয়ারবাজার কারসাজিতে। ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত তার কোম্পানি “বাংলাদেশ রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট” ২০১৩ সালের মধ্যেই ১০টি মিউচুয়াল ফান্ড পরিচালনার অনুমোদন পায়। তবে তদন্তে বেরিয়ে আসে, তিনি ফান্ডগুলোর টাকা ব্যবহারের মাধ্যমে পদ্মা ব্যাংকের শেয়ার কিনে এর মালিকানা দখল করেছিলেন।
এর পাশাপাশি, তিনি ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস, ন্যাশনাল টি কোম্পানি, ইউনিক মেঘনাঘাট পাওয়ারসহ আরও বেশ কয়েকটি তালিকাভুক্ত কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ নেন।
নাফিজ সরাফাত শুধু ব্যাংক ও শেয়ারবাজারেই দুর্নীতি সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং তিনি বিলাসবহুল হোটেল ব্যবসায়ও জড়িয়ে পড়েন। তিনি দ্য ওয়েস্টিন ঢাকা, লা মেরিডিয়ান ঢাকা, শেরাটন ঢাকা ও ম্যারিয়টসহ একাধিক আন্তর্জাতিক হোটেল চেইনের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।
সরকারি মালিকানাধীন ন্যাশনাল টি কোম্পানি (এনটিসি) নামমাত্র কিছু শেয়ার কিনে পুরো কোম্পানির দখল নিয়ে নেন সরাফাত ও শেখ হাসিনার চাচা শেখ কবির হোসেন। তারা প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যু করে কোম্পানির শেয়ার বাড়ানোর নামে দুর্নীতির জাল বিস্তার করেন।
একপর্যায়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়, এবং কোম্পানির সব কার্যক্রম দুর্নীতির কবলে পড়ে। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানটি কার্যত দেউলিয়া হয়ে পড়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে উঠে এসেছে, চৌধুরী নাফিজ সরাফাত ও তার পরিবারের নামে বিপুল পরিমাণ স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে।
তার নামে রয়েছে-
রাজধানীর গুলশানে ১০টি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট
গুলশান-২ এ ২০ তলাবিশিষ্ট একটি ভবন
পূর্বাচলে সাড়ে সাত কাঠার একটি প্লট
গাজীপুর ও বাড্ডায় ২৫ কাঠার জমি
তার স্ত্রী আনজুমান আরা শহীদের নামে ৫টি ফ্ল্যাট ও বসুন্ধরায় চারতলা বাড়ি
ছেলে চৌধুরী রাহিব সাফওয়ানের নামে ৭টি ফ্ল্যাট
৮৮৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিং মামলা
দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, নাফিজ সরাফাত ব্যাংক দখল, শেয়ারবাজার কারসাজি ও সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ লোপাটের মাধ্যমে প্রায় ৮৮৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
গত বছরের ১৬ আগস্ট তার বিরুদ্ধে ব্যাংক দখল ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুদক তদন্ত শুরু করে। এরপর ১ সেপ্টেম্বর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে পৃথক অনুসন্ধান শুরু করে।
দুদক ইতোমধ্যে তার বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি ক্রোকের জন্য আদালতে আবেদন করেছে। আদালত এই আবেদনের অনুমোদন দিয়েছেন এবং খুব শিগগিরই এসব সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন দুদকের পরিচালক মঞ্জুর মোর্শেদ।
দুদক ও পুলিশের তদন্তের মুখে নাফিজ সরাফাত দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন বলে তার ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন। তার মোবাইল ফোনও দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে।
সরকারিভাবে তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে দুদক জানিয়েছে, তার বিরুদ্ধে চলমান মামলা প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে তার প্রত্যর্পণের উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে।
এক সাধারণ ব্যাংক কর্মকর্তা থেকে দেশের অন্যতম বিতর্কিত অর্থলিপ্সু ব্যক্তিতে পরিণত হওয়া নাফিজ সরাফাতের গল্প দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের এক নিখুঁত উদাহরণ।
এখন দেখার বিষয়, তার বিপুল সম্পদ রাষ্ট্রের দখলে আনা সম্ভব হয় কিনা এবং তিনি আদৌ বিচারের মুখোমুখি হবেন কিনা।