শেখ হাসিনার নির্দেশে গুম ও হত্যা: এইচআরডব্লিউয়ের প্রতিবেদন

  • প্রধান উপদেষ্টার কাছে এইচআরডব্লিউ প্রতিবেদন হস্তান্তর: শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গুম ও হত্যার নির্দেশের অভিযোগ
  • বাংলাদেশে মানবাধিকার সংস্কারের আহ্বান

টুইট ডেস্ক: আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও রাজনৈতিক দমন-পীড়নের বিষয়ে তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন ‘আফটার দ্য মুনসুন রেভল্যুশন: আ রোডম্যাপ টু লাস্টিং সিকিউরিটি সেক্টর রিফর্ম ইন বাংলাদেশ’ প্রকাশ করেছে।

মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) সংস্থাটির একটি প্রতিনিধিদল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় গিয়ে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস-এর কাছে প্রতিবেদনটি হস্তান্তর করে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ক্ষমতাচ্যুত বাংলাদেশি একনায়ক শেখ হাসিনা সরাসরি গুম ও হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন’।

এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার শাসনামলে সরাসরি গুম ও হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এছাড়াও, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনের মূল বিষয়বস্তু-

১. গণগ্রেপ্তার ও রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধের আহ্বান

বাংলাদেশে গণগ্রেপ্তার বন্ধে পুলিশের জন্য গাইডলাইন তৈরির সুপারিশ করা হয়েছে। রাজনৈতিক সমালোচকদের দমনে ব্যবহৃত আইনের সংস্কার করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

২. বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুম বন্ধ

২০০৯-২০২৪ সালের মধ্যে প্রায় ২,০০০ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) বিলুপ্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার সাথে জড়িত কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়েছে।

৩. নির্বাহী ও বিচার বিভাগের সংস্কার

প্রশাসন, পুলিশ ও সামরিক বাহিনীতে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে। বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।

৪. গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা

নতুন অনুমোদিত ‘সাইবার প্রটেকশন অর্ডিন্যান্স ২০২৪’ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। গণমাধ্যমের ওপর দমন-পীড়ন বন্ধ এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিবেশ নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনের পর মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের নজর আরও গভীর হয়েছে। এইচআরডব্লিউ-এর প্রতিবেদনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে নিরাপত্তা বাহিনীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কার্যক্রমের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়, তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন হারানোর ঝুঁকি রয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে মার্চ মাসে অনুষ্ঠিতব্য অধিবেশনে বাংলাদেশ ইস্যুতে আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুসংহত করতে নির্বাচন ও নিরাপত্তা খাতে কাঠামোগত সংস্কার অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

প্রতিবেদন গ্রহণ করার সময় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘‘র‌্যাব তাদের অপরাধের জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছে, তবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুমের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।’’

এইচআরডব্লিউ-এর এশিয়া পরিচালক এলেইন পিয়ারসন বলেন, ‘‘বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চর্চা চলছিল। এই মুহূর্তে কাঠামোগত সংস্কার না হলে অন্তর্বর্তী সরকারের কষ্টার্জিত অগ্রগতি ব্যর্থ হতে পারে।’’

৫০ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনের শিরোনাম-‘আফটার দ্য মুনসুন রেভল্যুশন : আ রোডম্যাপ টু লাস্টিং সিকিউরিটি সেক্টর রিফর্ম ইন বাংলাদেশ।’

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া পরিচালক এলেইন পিয়ারসন বলেন, গুমে জড়িত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শেখ হাসিনা বা সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে জানতেন। অনেক ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা সরাসরি গুম ও হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

পিয়ারসন বলেন, ‘২০০৯-২০২৪ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার শাসনামলে নিরাপত্তা বাহিনী রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত ছিল এবং তারা শাসক দলের ক্যাডারের মতো আচরণ করত। এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন। আপনারা এখন পর্যন্ত যে অগ্রগতি করেছেন তাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। সংস্কারগুলোকে দৃঢ় করতে হবে এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে যথাযথ নজরদারির আওতায় আনতে হবে।’

এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে দ্রুত ও কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের কষ্টার্জিত অগ্রগতি ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। সংস্কারের ক্ষেত্রে ক্ষমতার পৃথকীকরণ এবং জনপ্রশাসন, পুলিশ, সামরিক, বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দিতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।

সংস্কার স্থায়ী করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে কারিগরি সহায়তা নিতে বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়ার পরিচালক এলেইন পিয়ারসন বলেন, প্রায় এক হাজার বাংলাদেশি গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে, শুরু হয়েছে একটি যুগান্তকারী অধ্যায়ের। বাংলাদেশে একটি অধিকার ও সম্মানজনক ভবিষ্যৎ গড়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ভবিষ্যতের সরকারের যে কোনো দমন-পীড়নকে প্রতিহত করতে দ্রুত ও কাঠামোগত সংস্কার করতে না পারলে অন্তর্বর্তী সরকারের কষ্টে অর্জিত অগ্রগতি সফল হবে না।

মার্চে অনুষ্ঠিতব্য মানবাধিকার কাউন্সিলের অধিবেশনে একটি ঐকমত্যের প্রস্তাব আনতে অন্তর্বর্তী সরকারকে আহ্বান জানানো হয়েছে। যাতে সংস্কার প্রক্রিয়াকে সমর্থন করার জন্য জাতিসংঘের অব্যাহত পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন নিশ্চিত করা যায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করা এবং গণহারে গ্রেপ্তার নিষিদ্ধে পুলিশের জন্য একটি গাইডলাইন অন্তর্বর্তী সরকারের তৈরি করা উচিত। একই সঙ্গে আইন মন্ত্রণালয়কে সমালোচকদের দমনে ব্যবহৃত আইন সংশোধন করতে হবে।

এছাড়া ‘আটক’সংক্রান্ত যত মামলা রয়েছে সেগুলোর বিচারে রিভিউ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। আটক যে কোনো ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত ও দ্রুত বিচারকের সামনে হাজির করার বিষয়েও সুপারিশ করা হয়েছে।

গত ১৫ বছরে প্রায় দুই হাজারের কাছাকাছি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব ক্ষেত্রে ওই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্তের মুখোমুখি করার ঘটনা নেই বললেই চলে। তদন্তের সময় সঠিকভাবে প্রক্রিয়া অনুসরণ করার আহ্বান জানিয়েছে এইচআরডব্লিউ।

এইচআরডব্লিউ-এর এই প্রতিবেদন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে গণ্য হতে পারে। এতে নির্বাচনী ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় দৃঢ় সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা উঠে এসেছে।

সরকারের জন্য এখন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই সুপারিশগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, যাতে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদে উন্নত হয়।