নতুন রূপে আবির্ভূত জামায়াতে ইসলামী!
টুইট ডেস্ক: ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে স্বাধীনতার পর জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ পায় দলটি। এরপর নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে তাদের রাজনীতি এগিয়েছে বাংলাদেশে। তবে গত ৫ গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও দলটির সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পালিয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণের পর নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে জামায়াতে ইসলামী।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দাবি করেছেন, বাংলাদেশের যে কোনো সময়ের তুলনায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বর্তমানে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় কার্যত কোনঠাসা হয়ে পড়া জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির জুলাই-আগস্টের পর রাজনীতিতে বেশ জোরেশোরেই নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছে। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার–উজ–জামান যে কয়টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করেন, তার মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান ছিলেন অন্যতম। যদিও তখনও কাগজে কলমে জামায়াত ছিল নিষিদ্ধ।
প্রসঙ্গত, সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৩১ জুলাই জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করে আওয়ামী লীগ সরকার। আর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে গত ২৮ আগস্ট এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।
ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর থেকে জামায়াত নেতারা বেশ সক্রিয়। নিয়মিত মিটিং মিছিলসহ রাজনীতির ময়দানে তাদের নানা কর্মসূচি দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের সময় ছাত্র শিবির অনেকটা গোপনে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করলেও এখন তারাও প্রকাশ্যে। বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের কমিটিও ঘোষণা করা হচ্ছে।
সময়ের সাথে রাজনৈতিক কৌশলেও পরিবর্তন এনেছে জামায়াত। অন্তত জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমানের নানা বক্তব্যে সেই বিষয়গুলোই ফুটে উঠেছে। তার ‘ক্ষমতায় এলে নারীদের পোশাক নিয়ে বাধ্য করা হবে না’, ‘আমরা সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু শব্দ শুনতে চাই না’ কিংবা ‘দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে জামায়াতে ইসলামী কখনো আপস করেনি’র মতো উক্তি এমনটাই নির্দেশ করে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, অনেক অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করে রাজনীতি করেছি। এখন দেশে ফ্যাসিবাদ নেই। তাই সব রাজনৈতিক দল তাদের রাজনীতি করার পূর্ণ স্বাধীনতা পাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
এর আগে গত জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন গণআন্দোলনে রূপ পায়, সে সময় জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। অবশ্য দলটির নিষিদ্ধ হওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম নয়।
জামায়াত গঠিত হয় ব্রিটিশ আমলে ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট। দলটির প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল হলেও মূলত সে সময় জামায়াত ছিল কমিউনিজম বিরোধী শক্তি। আর এ কারণে ব্রিটিশ শাসকদের আনুকূল্যও পায় দলটি। এমনকি ১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান গঠন হয়, তখন এর বিরোধিতাও করেছিল জামায়াত।
পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে পাকিস্তার রক্ষার জন্য তারা বাংলাদেশে পাক সেনাবাহিনী কর্তৃক গণহত্যার দোসর হিসেবে অভিযুক্ত হয়।
এদিকে ১৯৭৬ সালে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ নামের একটি রাজনৈতিক জোটের প্লাটফর্মে তৎপরতা শুরু করে জামায়াত। স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের প্রকাশ্য রাজনীতি শুরু হয় ১৯৭৯ সালে। আর নব্বইয়ের দশকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সক্রিয় হয় ইসলামী ছাত্র শিবির। পাকিস্তান আমলে এই সংগঠনটির নাম ছিল ইসলামী ছাত্র সংঘ।
নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতও অংশ নেয়। দলটি সবচেয়ে বড় সাফল্য পায় ১৯৯১ সালের নির্বাচনে। সেবার ১৮টি আসন পায় জামায়াত। পরে ওই জামায়াতের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি।
১৯৯২ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি যে আন্দোলন গড়ে তোলে, তাতে অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়ে জামায়াত। সে সময় গঠিত গণআদালতে গোলাম আজমের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়েছিল।
এর মধ্যেই ১৯৯৪ সালে আদালতের এক রায়ে নাগরিকত্ব ফিরে পান জামায়াত আমির গোলাম আজম। এরপর রাজনীতির মাঠে অনেকটাই উজ্জ্বীবিত হয় দলটি। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগের মতো জামায়াতও সক্রিয় ছিল।
১৯৯৯ সালে বিএনপির সাথে চার দলীয় জোট গঠন করে জামায়াত। ২০০০ সালে গোলাম আজম অবসরে যান। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন মতিউর রহমান নিজামী। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে। সেই মন্ত্রিসভায় মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ মন্ত্রিত্ব পান। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো সরকারের অংশ হয় জামায়াত।
অবশ্য ২০০৮ সালের নির্বাচনে মাত্র দুটি আসন পেয়েছিল জামায়াত। আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। ট্রাইব্যুনালের মামলায় জামায়াতের তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামীসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজন নেতার মৃত্যুদণ্ড হয়। দলটির সাবেক আমির গোলাম আজমেরও সাজা হয়েছিল। পরে ২০১৪ সালে যুদ্ধাপরাধের সাজা মাথায় নিয়ে মৃত্যু হয় তার।
এছাড়া ২০১৫ সালে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ এবং ২০১৬ সালে আমির মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। এতে রাজনীতির ময়দানে ব্যাপক কোণঠাসা হয়ে পড়ে জামায়াত।
এছাড়াও ২০১৩ সালে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে হাইকোর্ট। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল হলে ২০২৩ সালের নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট জামায়াতের আবেদন খারিজ করে দেয়। নিবন্ধন না থাকায় বিতর্কিত তিনটি নির্বাচনে দলটি অংশ নিতে পারেনি। এমনটি ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি এলেও জামায়াতের সে সুযোগ ছিল না।