ইউটিউব দেখে অ’স্ত্র চালানো শিখে প্রেমিকাকে হ’ত্যা করেন সেই প্রেমিক

টুইট ডেস্ক : আড়াই মাসের অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় বিয়ের জন্য চাপ দিলে প্রেমিকা শাহিদা ইসলাম রাফাকে মুন্সীগঞ্জের ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে এনে পরিকল্পিতভাবে গুলি করে হত্যা করেন প্রেমিক তৌহিদ শেখ তন্ময় (২৩)। হত্যার কাজে ব্যবহৃত পিস্তলটি তৌহিদ গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন রাজধানীর ওয়ারি থানা থেকে লুট করেন। পরে ইউটিউবে ভিডিও দেখে তিনি পিস্তল চালানো শিখেন।

মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) বিকেল ৩টার দিকে মুন্সীগঞ্জ আদালতে হাজির করলেন আদালতের বিচারক সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জুলফিকার হোসাইন রনির কাছে আসামি তৌহিদ ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তৌহিদের বরাদ দিয়ে এসব তথ্য জানিয়েছেন ওই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জেলা ডিবি পুলিশের উপ পরিদর্শক ইয়াসিন।

ডিবির তদন্তকারী কর্মকতা ইয়াসিন বলেন, তন্ময়ের বিরুদ্ধে মোট ৩টি মামলা হয়েছে। হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্রটি কেরাণীগঞ্জ ডোবা থেকে উদ্ধারের ঘটনায় কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় একটি মামলা হয়েছে। এছাড়া ওয়ারি থানা থেকে অস্ত্র লুটের ঘটনায় ওই থানায় দায়েরকৃত মামলায় তাকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হবে।

এছাড়া মুন্সীগঞ্জে গুলি করে শাহিদাকে হত্যা করার ঘটনায় অপর একটি মামলাসহ সব মিলিয়ে ৩টি মামলার আসামি সে। হত্যায় ব্যবহৃত পিস্তলটি তৌহিদ গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন রাজধানীর ওয়ারি থানা থেকে লুট করেন। পূর্বে অস্ত্র চালানোর অভিজ্ঞা না থাকায় সে ইউটিউবে ভিডিও দেখে পিস্তল চালানো শিখেছে।

তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, টিকটকে পরিচয় হয় শাহিদার সঙ্গে তৌহিদের। ৪ বছর চুটিয়ে প্রেম করলেও প্রেমিক তৌহিদ শাহিদাকে বিয়ে করতে চায়নি। সে বিয়ে করতে চেয়ে ছিল পরিবারের ইচ্ছায়। এ নিয়ে তাদের মধ্যে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। একটি দুইটি নয়, প্রকাশ্যে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের ওপর ৫ রাউন্ড গুলি ছুড়ে আড়াই মাসের অন্তঃসত্ত্বা প্রেমিকাকে হত্যার পর ভোলার মনপুরা দ্বীপে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে আলোচিত শাহিদা হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি তৌহিদ।

গত সোমবার ভোরে ভোলার তারানগর ইউনিয়নের ইলিশঘাটে ঢাকা-মনপুরা রুটের লঞ্চ থেকে তন্ময়কে গ্রেপ্তার করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। পরে তার দেওয়া তথ্যে ঢাকার কেরাণীগঞ্জের বটতলী বেইলি ব্রিজের নিচে পানি থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত সরকারি সেভেন পয়েন্ট সিক্স ফাইভ অস্ত্রটি উদ্ধার করা হয়। মঙ্গলবার দুপুরে পুলিশ সুপার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে এসব তথ্য জানান মুন্সীগঞ্জ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ শামসুল আলম সরকার।

পুলিশ জানায়, নিহত শাহিদার একাধিক সম্পর্ক নিয়ে তৌহিদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল। ঘটনার আগের দিন ২৯ নভেম্বর শাহিদাকে ফোন করে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের করেন তৌহিদ। পরে লোকাল বাসে করে দুজনেই চলে আসে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ঘাটে।

রাতভর সেখানে ঘোরাঘুরির পর শনিবার (৩০ নভেম্বর) ভোর সাড়ে ৬টার দিকে খানবাড়ি সিএনজি স্ট্যান্ড এলাকায় আসেন তারা। সেখানে প্রেমিকা শাহিদা নিজেকে আড়াই মাসের অন্তঃসত্ত্বা দাবি করে প্রেমিক তৌহিদকে বিয়ের জন্য চাপ দেন।

আশপাশের লোকজন তাদের মধ্যে চিল্লাচিল্লি শুনে এগিয়ে আসতে থাকলে তৌহিদ ওই নারীকে নিয়ে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের সার্ভিস লেন ধরে পদ্মা সেতু উত্তর টোল প্লাজা থেকে ২০০ মিটার অদূরে দোগাছি ফুটওভার ব্রিজ পার করেন। পথে কয়েক দফায় শাহিদাকে চড়থাপ্পড় মারেন তৌহিদ।

একপর্যায়ে আর রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সঙ্গে থাকা থানা থেকে লুট করা পিস্তল দিয়ে প্রথমে গুলি ছুড়লে সেটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। পরপরই আরও ৫ রাউন্ড গুলি ছুড়লে সেগুলো শাহিদার শরীরের বিভিন্ন অংশে বিদ্ধ হয়। মুহূর্তেই সড়কে পড়ে শাহিদার মৃত্যু হয়।

রক্তাক্ত প্রেমিকার মরদেহ ফেলে দৌঁড়ে পিছন ফিরে যান তৌহিদ। পুনরায় খানবাড়ি এলাকায় গিয়ে লোকাল বাসে চড়ে রওনা দেন ঢাকার উদ্দেশ্যে। মাঝপথে পিস্তলটি ফেলে যান কেরাণীগঞ্জ বটতলী এলাকার বেইলি ব্রিজের নিচে। বিভিন্ন জায়গায় আত্নগোপনে যাওয়ার চেষ্টা করেন তৌহিদ। একপর্যায়ে আটিবাজার এলাকায় নিজের বোনের বাড়িতে গিয়ে ওঠেন তিনি। ওই বাড়িতে বোন জামাই, বোন ও তৌহিদের মা লঞ্চে করে মনপুরা দ্বীপে আত্মগোপনে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন তৌহিদকে।

পরদিন রোববার সন্ধ্যায় ওই ৩ জন সদরঘাট গিয়ে পৌঁছে দেয় তাকে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকা-ভোলা-মনপুরা রুটের লঞ্চে উঠে পড়ে তৌহিদ। এদিকে শাহিদা হত্যার বিষয়টি সারাদেশে আলোড়ন তৈরি করলে আটঘাট বেঁধে মাঠে নামে ডিবি। তৌহিদকে প্রধান সন্দেহভাজন চিহ্নিত করে তার মোবাইল নাম্বারের সর্বশেষ লোকেশন নিশ্চিত হয় ডিবি।

তখন দেখা যায়, তৌহিদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি শুক্রবার রাতে সবশেষ ঢাকার ওয়ারি এলাকায় চালু ছিল। এরপর থেকে সেটি বন্ধ। তখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসে তাহলে ডিবির সন্দেহ কি ভুল! এরই মাঝে আরেকটি সূত্র খুঁজে পায় ডিবি। তৌহিদের মোবাইল কলের সূত্র ধরে উদঘাটন হয় পরিবারের সব সদস্যের নাম্বার।

রোববার ডিবির দলটি যখন ঢাকার আটিবাজারে তৌহিদের বোনের বাড়িতে অভিযানে যায় তখন তারা একসঙ্গে তৌহিদের মা, বোন ও বোন জামাইয়ের মোবাইলের লোকেশন সদরঘাটে দেখতে পায়। এরপরে অভিযান কার্যক্রম আরও জোরদার করে ডিবি। চৌকস টিমটি ছুটে যায় সদরঘাটে। সিসিটিভি ক্যামেরায় তৌহিদের লঞ্চে ওঠার দৃশ্য শনাক্ত করে তারা।

গ্রেপ্তারের পর ডিবির কাছে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ওই যুবক জানান, গ্রেপ্তার এড়াতে কৌশলের অংশ হিসাবে মাওয়া আসার আগে ঢাকার ওয়ারিতে থাকতেই মোবাইলটি বন্ধ করে দেন তিনি। যাতে হত্যার পর লুকালেও পুলিশ কোনো ক্লু বের করতে না পারে।

এদিকে সোমবার ভোরে মুন্সীগঞ্জ ডিবি পুলিশের ৫ সদস্যের ওই টিমটি অবস্থান নেয় ভোলার ইলিশা লঞ্চঘাটে। টার্গেট করা লঞ্চে অনুসন্ধানে ডিবির হাতে ধরা পড়েন তৌহিদ। গত রোববার সকালে নিহত শাহিদা ইসলাম রাফার মা জরিনা খাতুন শ্রীনগর থানায় প্রেমিক তৌহিদ শেখ তন্ময়কে অভিযুক্ত করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওইদিন দুপুরে মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ময়নাতদন্তের পর রাতে ময়মনসিংহ সদরের বেগুনবাড়ি এলাকায় জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয় শাহিদার।

নিহত শাহিদা রাজধানী ঢাকার ওয়ারিতে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন ও নারিন্দা এলাকার বলধা গার্ডেন সংলগ্ন জনৈক কামাল মিয়ার বাড়িতে দেখাশোনার (ডে-কেয়ার) কাজ করতেন। ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বেগুনবাড়ি গ্রামের মৃত মোতালেবের মেয়ে তিনি। তারা ২ ভাই ও ৩ বোন। তাছাড়া ৭-৮ বছর আগে শাহিদার একটি বিয়েও হয়েছিল। পরে সেই সম্পর্ক টিকেনি। গ্রেপ্তারকৃত তৌহিদ শেখ তন্ময় রাজধানী ঢাকার ওয়ারী থানার বর্ণগ্রাম এলাকার মৃত শফিক শাহের ছেলে।

এ ব্যাপারে মুন্সীগঞ্জ কোট পুলিশের পরিদর্শক রাশেদ খান চৌধুরী বলেন, আসামিকে দুপুর ২টার দিকে আদালতে হাজির করলে আদালতের বিচারক সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জুলফিকার হোসাইন রনি আসামির দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ করেন।