বিশ্বজুড়ে কমছে এইডসে আক্রান্ত-মৃত্যুর হার
টুইট ডেস্ক: বিশ্বজুড়ে উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে প্রাণঘাতী রোগ এইডসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে এ তথ্য।
ল্যানসেটে প্রকাশিত সেই প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ২০১০ সালের পর থেকে বিশ্বজুড়ে এই রোগে আক্রান্তের হার হ্রাস পেয়েছে এক পঞ্চমাংশ এবং মৃতের হার হ্রাস পেয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। প্রবন্ধে আরও বলা হয়েছে, ২০১০ সালের পূর্বে এইডসে আক্রান্ত হয়ে এক বছরে যত মানুষের মৃত্যু হতো, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তার চেয়ে প্রায় ১০ লাখ মৃত্যু কম হচ্ছে।
এইডসের মূল ‘ঘাঁটি’ বা ভরকেন্দ্র ছিল আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলের দেশগুলো। ল্যানসেটের গবেষণা প্রবন্ধ বলছে, গত ১৫ বছরে এসব দেশে নাটকীয়ভাবে কমে এসছে আক্রান্ত-মৃত্যুর হার। তবে এই সময়সীমায় পূর্ব ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এ রোগে আক্রান্ত-মৃত্যুর ঊর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
গবেষণা প্রবন্ধটির প্রধান লেখক হেমওয়ে কিউ বার্তাসংস্থা এএফপিকে এ প্রসঙ্গে বলেন, “এইডসের বিস্তার হ্রাস পাওয়ার একটি বড় কারণ শনাক্ত ও চিকিৎসার ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পাওয়া। এই মুহূর্তে বিশ্বজুড়ে এইডস রোগী আছেন ৪ কোটি এবং প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখ মানুষ এইডসে আক্রান্ত হচ্ছেন। এই আক্রান্তদের মধ্যে চিকিৎসাবঞ্চিত হচ্ছেন প্রায় এক তৃতীয়াংশ। পূর্বে চিকিৎসাবঞ্চিতদের হার আরও অনেক বেশি ছিল।”
তবে আক্রান্ত-মৃত্যুর হার কমে এলেও ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবী থেকে ভয়াবহ এ রোগটি নির্মূলের যে লক্ষ্য নিয়েছিল জাতিসংঘ, তা এখনও অনেক দূরে বলে জানিয়েছেন হেমওয়ে কিউ।
কার্যকর হাতিয়ার
আফ্রিকার সাব সাহারান অঞ্চলে এইডসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার হয়ে উঠেছে প্রি-এক্সপোজার প্রোফাইলেক্সিস (প্রেপ) নামের একটি মুখে খাওয়ার ওষুধ বা পিল। এইডস মূলত ছড়ায় অনিরাপদ যৌন সঙ্গমের মাধ্যমে এবং প্রেপ নামের এই পিলটি সেবন করলে সঙ্গম প্রায় ৯৯ শতাংশ নিরাপদ থাকে।
প্রতিদিন সেবনযোগ্য এই পিলের কল্যাণে সাব-সাহারান অঞ্চলসহ বিশ্বের বহু দেশে এইডসে আক্রান্তের হার কমছে। ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে প্রেপকে আরও সহজলভ্য করে তুলতে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা চলছে।
অনেক সময় এইডসে আক্রান্ত প্রসূতী মায়েদের বুকের দুধের মাধ্যমেও এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে নবজাতকের দেহে। এ ধরনের সংক্রমণ রোধ করতে এইডস উপদ্রুত দেশগুলোতে শুরু হয়েছে অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি নামের একপ্রকার চিকিৎসা। এই থেরাপির ফলে এইডস পুরোপুরি নির্মূল করা না গেলেও মা ও শিশু উভয়ের দেহের অভ্যন্তরে থাকা এইচআইভি ভাইরাসের পরিমাণ ব্যাপক হারে হ্রাস করা সম্ভব।
আশা জাগাচ্ছে নতুন ওষুধ
অ্যান্টি রেট্রোভাইরাল থেরাপিতে যে ওষুধটি ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটির নাম লিনাক্যাপাভির। গবেষণায় দেখা গেছে, এ ওষুধটি এইচআইভির সংক্রমণ প্রতিরোধে ১০০ভাগ কার্যকর। বছরে মাত্র দু’বার ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে এটি গ্রহণ করতে হয়।
লিনাক্যাপাভিরের প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান মার্কিন ওষুধ ও টিকা কোম্পানি গিলিড। যুক্তরাষ্ট্রে ইতোমধ্যে চিকিৎসা ক্ষেত্রে এটি ব্যবহারও শুরু হয়েছে, তবে এটি খুব ব্যয়বহুল ওষুধ। যে দুই ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে এ ওষুধটি গ্রহণ করতে হয়, সে দুই ডোজের জন্য রোগীকে ব্যয় করতে হয় প্রায় ৪০ হাজার ডলার।
তবে গবেষকরা গিলিডকে ওষুধটির দাম কমানোর আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, যে প্রযুক্তিতে এবং যেসব উপাদান ব্যবহার করে এ ওষুধটি প্রস্তুত করা হয়, তাতে এক একটি ডোজ উৎপাদনে খরচ পরে মাত্র ৪০ ডলার বা তার কিছু বেশি।
নিজেদের ওষুধের দাম অবশ্য কমায়নি গিলিড। তবে গবেষকদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে গত মাসে কোম্পানি বলেছে, লিনাক্যাপাভিরের ৬ টি জেনেরিক (ভিন্ন নামে একই ওষুধ) প্রস্তুতের সিদ্ধান্ত নিয়েছে গিলিড। বাইরের বিভিন্ন কোম্পানিকে এসব জেনেরিক উৎপাদনের লাইসেন্স দেওয়া হবে। কয়েকটি কোম্পানির সঙ্গে এ সংক্রান্ত চুক্তিও স্বাক্ষর হয়েছে বলে জানিয়েছেন গিলিডের এক কর্মকর্তা।
টিকা আর কতদূর
গত কয়েক দশক ধরে এইডসের টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে। এখনও সফল হয়নি সেসব প্রচেষ্টা। আপাতত লিনাক্যাপাভিরকেই এইডসের টিকা হিসেবে বিবেচনা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
“আমরা জানি না যে কবে নাগাদ এইডসের টিকা আবিষ্কার হবে। তার আগ পর্যন্ত লিনাক্যাপাভিরের ওপরই ভরসা করতে হবে আমাদের। কারণ বাজারে এই মুহূর্তে যেসব টিকা পাওয়া যাচ্ছে, সেসবের মধ্যে এটিই সবচেয়ে কার্যকর”, এএফপিকে বলেন যুক্তরাজ্যের গবেষক অ্যান্ড্রু হিল।
এইডস এবং এইচআইভি
এইডস আসলে একই সঙ্গে রোগ এবং রোগলক্ষণসমষ্টি। এইচআইভি ভাইরাস মানবদেহে প্রবেশ করতে পারলে সেটি মানুষের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও প্রতিরক্ষাকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে, একজন এইডস রোগী খুব সহজেই যে কোনো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন, যা শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যু ঘটাতে পারে। এইচআইভি সংক্রমণের পরবর্তী অবস্থাকেই এইডস বলা হয়।
গত শতকের ১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম এইডসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। ওই বছরই দেশটির রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) এই রোগের জন্য দায়ী ভাইরাস এইচআইভিও শনাক্ত করে।
অনিরাপদ যৌনতা, সিরিঞ্জের সূঁচের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে এইচআইভি ভাইরাস। এছাড়া, মায়ের মাধ্যমেও এইডসে আক্রান্ত হয় শিশুরা। কোনো গর্ভবতী নারীর দেহে এইডসের জীবাণু থাকলে তা অনাগত সন্তানকেও সংক্রমিত করে।
সাহারা ও নিম্ন আফ্রিকার অঞ্চলগুলোতে এইডসের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষ মারা যান এইডসে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, ২০১৮ সালে বিশ্বে এইডসে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন ১০ লাখ মানুষ।