দায়িত্ব নিয়েই যে ৭ কাজ করবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প

টুইট ডেস্ক : ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমালা হ্যারিসকে হারিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর এর মাধ্যমে দেশটির প্রায় আড়াইশো বছরের ইতিহাসে দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে এক মেয়াদের বিরতিতে দ্বিতীয়বারের মতো হোয়াইট হাউসে ফিরছেন সাবেক এই রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট।

মূলত অভিবাসন, অর্থনীতি এবং ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধসহ বেশ কয়েকটি ইস্যুতে পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প ফিরে আসতে চলেছেন হোয়াইট হাউসে। তার রিপাবলিকান পার্টি সিনেটের নিয়ন্ত্রণ ফের দখলে নেওয়ায় কংগ্রেসে এখন নিজের রাজনৈতিক এজেন্ডার জন্য তিনি প্রচুর সমর্থনও পাবেন বলে মনে করা হচ্ছে।

সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলছে, নিজের বিজয় ভাষণে ট্রাম্প “একটি সাধারণ নীতিবাক্য দ্বারা দেশ শাসনের” প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর তা হলো- “প্রতিশ্রুতি দেওয়া, প্রতিশ্রুতি রাখা। আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে যাচ্ছি।”

তবে কিছু ক্ষেত্রে, তিনি কীভাবে তার লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে পারেন তার সামান্য বিশদ বিবরণ তিনি দিয়েছেন। ২০২৩ সালে ফক্স নিউজ তাকে প্রশ্ন করেছিল, ক্ষমতায় গেলে তিনি তার ক্ষমতার অপব্যবহার করবেন কিনা বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে টার্গেট করবেন কিনা।

জবাবে ট্রাম্প উত্তর দিয়েছিলেন, “প্রথম দিন ব্যতীত” তিনি তা করবেন না। তিনি বলেছিলেন, “না, না, না, প্রথম দিন ছাড়া। আমরা সীমান্ত বন্ধ করে দিচ্ছি এবং আমরা ড্রিলিং, ড্রিলিং, ড্রিলিং করছি। এরপরে, আমি স্বৈরশাসক নই।”

১) অনথিভুক্ত অভিবাসীদের নির্বাসন

নির্বাচনের প্রচারণা চালানোর সময় মার্কিন ইতিহাসে অনথিভুক্ত অভিবাসীদেরকে সবচেয়ে বড় গণ বিতাড়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ট্রাম্প। তিনি মেক্সিকো সীমান্তে প্রাচীর নির্মাণের কাজও সম্পূর্ণ করার অঙ্গীকার করেছেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার প্রথম মেয়াদের সময় ওই প্রাচীর নির্মাণ শুরু হয়েছিল।

জো বাইডেন-কমালা হ্যারিস প্রশাসনের অধীনে গত বছরের শেষে মার্কিন দক্ষিণ সীমান্তে অভিবাসীদের ক্রসিংয়ের সংখ্যা রেকর্ড স্তরে পৌঁছেছিল। তবে ২০২৪ সালে তা কিছুটা কমে এসেছে।

বিশেষজ্ঞরা বিবিসিকে বলেছেন, ট্রাম্পের যেভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেভাবে অভিবাসীদের নির্বাসনে পাঠানো হলে তা বিশাল আইনি এবং লজিস্টিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে এবং এই পদক্ষেপ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও মন্থর করতে পারে।

২) অর্থনীতি, ট্যাক্স এবং শুল্কের ওপর পদক্ষেপ

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের এক্সিট পোল বা বুথফেরত জরিপের প্রাথমিক তথ্যে দেখা যাচ্ছে, মার্কিন ভোটারদের কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে যে দুটি ইস্যু তার একটি হচ্ছে— অর্থনীতির অবস্থা। ট্রাম্প “মুদ্রাস্ফীতির অবসানের” প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে মুদ্রাস্ফীতি ফের কমে আসার আগে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অধীনে এটি বেশ উচ্চ স্তরে পৌঁছে গিয়েছিল। তবে পণ্যের দামকে সরাসরি প্রভাবিত করার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা সীমিত।

এছাড়া ট্রাম্প ব্যাপকভাবে কর কমানোর প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। তিনি টিপসকে করমুক্ত করার, সামাজিক নিরাপত্তা প্রদানের ওপর কর বাতিল এবং কর্পোরেশন ট্যাক্স ছেটে ফেলার প্রস্তাব করেছেন।

তিনি বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে বেশিরভাগ বিদেশি পণ্যের ওপর কমপক্ষে ১০ শতাং নতুন শুল্ক প্রস্তাব করেছেন। চীন থেকে আমদানিতে অতিরিক্ত ৬০ শতাংশ শুল্ক থাকতে পারে বলে তিনি বলেছেন। কিছু অর্থনীতিবিদ সতর্ক করেছেন, এই ধরনের পদক্ষেপগুলো সাধারণ মানুষের জন্য পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে।

৩) জলবায়ু সংক্রান্ত বিধিনিষেধ কমানো

মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের প্রথম মেয়াদে শত শত পরিবেশগত সুরক্ষা বিধিনিষেধ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিয়েছিলেন ট্রাম্প। একইসঙ্গে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে আমেরিকাকে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকেও প্রত্যাহার করেছিলেন তিনি।

আর এবার তিনি আবারও বিধিনিষেধ কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, বিশেষত আমেরিকান গাড়ি শিল্পকে সাহায্য করার উপায় হিসাবে। তিনি ক্রমাগত বৈদ্যুতিক যানবাহন ব্যবহার সংক্রান্ত বাইডেন প্রশাসনের নীতির সমালোচনা করেছেন।

তিনি মার্কিন জীবাশ্ম জ্বালানির উৎপাদন বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং বায়ু শক্তির মতো নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসের পক্ষে প্রথম দিনেই কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

তিনি তেল খননের জন্য আর্কটিক মরুভূমির মতো এলাকাগুলো উন্মুক্ত চান। আর এ বিষয়ে তার যুক্তি, এতে জ্বালানি খরচ কম হবে। যদিও এই বিষয়ে বিশ্লেষকরা সন্দিহান।

৪) ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান

টানা আড়াই বছর ধরে ইউক্রেনে আগ্রাসন চালাচ্ছে রাশিয়া। আর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সহায়তায় রশিয়ার বিরুদ্ধে পাল্টা হামলা করছে কিয়েভ। রাশিয়ার সাথে এই যুদ্ধে ইউক্রেনকে সহায়তা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয়ের সমালোচনা করেছেন ট্রাম্প। একইসঙ্গে আলোচনার চুক্তির মাধ্যমে “২৪ ঘণ্টার মধ্যে” সংঘাত শেষ করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তিনি।

অবশ্য উভয় পক্ষেরই হাল ছেড়ে দেওয়া উচিত বলে মনে করার কথাও তিনি বলেননি। তবে ডেমোক্র্যাটরা বলছেন, এই পদক্ষেপ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে উৎসাহিত করবে।

ট্রাম্প চান, যুক্তরাষ্ট্র বিদেশি সংঘাত থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করুক। গাজা যুদ্ধ সম্পর্কে বলতে গিয়ে— ট্রাম্প নিজেকে ইসরায়েলের কট্টর সমর্থক হিসাবে জানান দিয়েছেন, তবে আমেরিকান মিত্রকে (ইসরায়েলকে) গাজায় তার অভিযান বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি লেবাননে সম্পর্কিত সহিংসতাও বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তবে সেটি তিনি কীভাবে করবেন সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানাননি ট্রাম্প।

৫) গর্ভপাত নিষিদ্ধ নয়

কমালা হ্যারিসের সাথে প্রেসিডেনশিয়াল বিতর্কের সময় ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি জাতীয় গর্ভপাত নিষেধাজ্ঞার আইনে স্বাক্ষর করবেন না। নিজের কিছু সমর্থকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েই ট্রাম্প একথা বলেছিলেন।

এর আগে ২০২২ সালে গর্ভপাতের দেশব্যাপী সাংবিধানিক অধিকার সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে বাতিল হয়ে যায়। আর তাই এই অধিকারের বিষয়টি নির্বাচনের আগে কমালা হ্যারিসের জন্য প্রধান প্রচারণার বিষয় হয়ে ওঠে এবং বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্য ভোটের দিনে গর্ভপাতের অধিকার রক্ষা বা প্রসারিত করার ব্যবস্থাও অনুমোদন করে।

অন্যদিকে ট্রাম্প নিজে নিয়মিত বলেছেন, অঙ্গরাজ্যগুলোকে গর্ভপাতের বিষয়ে তাদের নিজস্ব আইনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য স্বাধীনতা দেওয়া উচিত। তবে এই ইস্যুতে নিজের একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ বার্তা খুঁজে পেতে সংগ্রাম করেছেন তিনি।

৬) ৬ জানুয়ারির ঘটনায় কিছু দাঙ্গাকারীকে ক্ষমা করবেন

২০২১ সালের গত ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ভবন ক্যাপিটলে জো বাইডেনকে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দিতে যৌথ অধিবেশন বসেছিল কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস এবং উচ্চকক্ষ সিনেট সদস্যদের। অধিবেশন চলাকালে সেখানে হামলা করেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের কয়েক হাজার উন্মত্ত সমর্থক।

ওই দাঙ্গায় পুলিশ সদস্যসহ নিহত হয়েছিলেন ৫ জন। ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়ার মাত্র দুই সপ্তাহ আগে হওয়া এই হামলার ঘটনায় ট্রাম্পের উস্কানি ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে ট্রাম্প বরারবই এই অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছেন।

আর এখন ট্রাম্প বলছেন, ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ওয়াশিংটন ডিসিতে দাঙ্গার সময় অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হওয়া কয়েকজনকে “মুক্ত” করবেন তিনি। ভয়াবহ সেই দাঙ্গার ঘটনার গুরুত্ব বা তাৎপর্য কমিয়ে আনার জন্য কাজ করেছেন ট্রাম্প এবং এই ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হওয়া শত শত সমর্থককে রাজনৈতিক বন্দী হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন।

ট্রাম্প দাবি করেছেন, দাঙ্গার ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অনেককে “ভুলভাবে কারারুদ্ধ করা হয়েছে”। যদিও তিনি স্বীকার করেছেন, “তাদের মধ্যে কয়েকজন ঘটনার সময় সম্ভবত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল”।

৭) স্পেশাল কাউন্সেল জ্যাক স্মিথকে বরখাস্ত করবেন

প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার “দুই সেকেন্ডের মধ্যে” স্পেশাল কাউন্সেল জ্যাক স্মিথকে বরখাস্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ট্রাম্প। প্রবীণ এই প্রসিকিউটর ট্রাম্পের বিরুদ্ধে দুটি ফৌজদারি তদন্তের নেতৃত্ব দিয়েছেন।

বিবিসি বলছে, স্পেশাল কাউন্সেল জ্যাক স্মিথ ২০২০ সালের নির্বাচনের ফল বাতিলের কথিত প্রচেষ্টার জন্য এবং গোপন নথিগুলোর ভুল ব্যবস্থাপনার জন্য ট্রাম্পকে অভিযুক্ত করেছেন।

তবে ট্রাম্প কোনো ধরনের অন্যায় কাজ করার কথা অস্বীকার করেছেন এবং নির্বাচনের আগে উভয় ক্ষেত্রেই বিচারের মুখোমুখি হওয়া রোধ করতে সক্ষম হয়েছেন।