সেই ফোন কল ছিল বড় চমক: ইউনূস

টুইট ডেস্ক : প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস মনে করেন, যে পরিবর্তনের জন্য মানুষ প্রাণ দিয়েছে, সেই আত্মত্যাগ অর্থবহ করতে বাংলাদেশকে নতুন করে গড়ে তোলার বিকল্প নেই, আর সেই পরিবর্তনের প্রশ্নে ‘সবাই ঐক্যবদ্ধ’।

তার ভাষায়, “আমরা আর পুরনো চর্চায় ফিরে যেতে রাজি নই।”

জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম এনপিআরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। বাংলাদেশের নতুন বাস্তবতা ও ভবিষ্যত ভাবনার কথা উঠে এসেছে সেই আলাপচারিতায়।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসন অবসানের পর অভ্যুত্থানকারীদের ইচ্ছায় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নেন নোবেলজয়ী ইউনূস।

শেখ হাসিনা সরকারের যখন পতন হয়, ইউনূস তখন গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক উপলক্ষে বাংলাদেশ থেকে পাঁচ হাজার মাইল দূরে, প্যারিসে আবস্থান করছিলেন। হাসিনার আমলে দায়ের হওয়া দুর্নীতি আর অর্থ আত্মসাতের মামলায় কারাগারে যাওয়ার ঝুঁকির মধ্যে ছিলেন তিনি।

কিন্তু ৫ অগাস্টের পর সারা বাংলাদেশের মত ইউনূসের জীবনের গতিপথও যে বদলে গেছে, সে কথা তিনি এনপিআরকে বলেছেন।

মিশেল মার্টিন: গত গ্রীষ্মে যখন আমরা কথা বলেছিলাম, আপনি তখন দুর্নীতির অভিযোগে বিচারাধীন ছিলেন এবং এখন আপনি বিশ্ব মঞ্চে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন। এসব কিছুই ঘটনার পালাবদল। নিজেকে এই অবস্থানে দেখে অবাক হচ্ছেন?

মুহাম্মদ ইউনূস: বলতে হবে, ঘটনাপ্রবাহের অদ্ভূত পালাবদল। আমি প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে শপথ নেওয়ার আগে প্যারিসে ছিলাম। বোঝার চেষ্টা করছিলাম, আমি যদি ফিরে যাই, আমাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে, কারণ তিনি (শেখ হাসিনা) আমার ওপর ক্রোধান্বিত হবেন এবং আমাকে জেলে পাঠাবেন। তাই ভাবছিলাম ফিরতে দেরি করব কি না। হঠাৎ বাংলাদেশ থেকে একটা ফোন পেলাম যে, ‘তিনি (শেখ হাসিনা) দেশ ছেড়েছেন। আমরা চাই আপনি সরকার প্রধান হন।’ এটা ছিল একটা বড় চমক।

মার্টিন: আপনি যখন ফোনটি পেলেন, তখন আপনার মনে কী ঘটছিল?

ইউনূস: ভাবছিলাম, দেশ পরিচালনায় আমার আদৌ যুক্ত হওয়া উচিত কি না। এটা খুবই কঠিন রাজনৈতিক পরিস্থিতি। কিন্তু ছাত্ররা যখন আমাকে ফোন করে ব্যাখ্যা করল যে পরিস্থিতি আসলে কেমন; শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, তোমরা এর জন্য জীবন দিয়েছ। তোমরা যদি জীবন দিতে পার, আমিও আমার অন্য সব ভাবনা বাদ দিতে পারি। আমি তোমাদের সেবায় নিয়োজিত হতে পারি, এটা আমি করব।’

মার্টিন: আপনি যখন বলেন যে তারা জীবন দিয়েছে, এটা মোটেও অতিরঞ্জন নয়, রূপকার্থেও নয়।

ইউনূস: না, এটা কোনো রূপক নয়। মানুষ মারা গেছে। প্রায় এক হাজার যুবক মারা গেল, বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে বুক পেতে বুলেট নিল। আক্ষরিক অর্থে যুবকরা এসে আত্মাহুতি দিয়েছে। তারা যখন বিক্ষোভে যোগ দিতে তাদের বাড়ি থেকে বের হয়েছিল, তারা বাবা-মাকে বিদায় জানিয়ে এসেছিল। তারা তাদের ভাইবোনদের বিদায় জানিয়ে বলছে; ‘আমি হয়ত ফিরে আসব না।’ এটাই সেই চেতনা, যার মধ্য দিয়ে পুরো ব্যাপারটা ঘটেছে। আর তারপর যেটা ঘটল, একেবারেই অবিশ্বাস্য ছিল। প্রধানমন্ত্রী দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, কারণ বিপুল জনতা তার বাড়ির দিকে যাচ্ছিল।

মার্টিন: এই আন্দোলন এক দিকে খুবই অজনপ্রিয় কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত নেতার প্রস্থান ডেকে এনেছে। কিন্তু পালাবদলের শুরুর দিকে বিশৃঙ্খলার মধ্যে আহমদিয়া ও হিন্দুদের ওপর হামলা হয়েছিল। এসব ঘটনার কিছু ছিল শেখ হাসিনার দলের প্রতি তাদের আনুগত্যের কারণে। কিছু ঘটনা কেবলই সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ বলে মনে হয়েছে। সেসব ঘটনা কমে এসেছে। কিন্তু তারপর থেকে আরও হামলা হয়েছে- এইবার মাজারে। আমাদের প্রতিবেদন অনুসারে সরকার পতনের পর থেকে ২০টির বেশি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, গণপিটুনিতে মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কেন এমন হচ্ছে?

ইউনূস: জনগণ বিপ্লবের মেজাজে আছে। সুতরাং এটি একটি বিপ্লবী পরিস্থিতি। তাদের অনেককে হত্যা করা হয়েছে; তাই তারা এমন লোকদের খুঁজছে, যারা তাদের সহকর্মীদের মৃত্যু ঘটিয়েছে। তাই জনগণ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন দলের অনুসারীদের ওপর হামলা চালাচ্ছিল। আপনি যখন বলেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হচ্ছে, সেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায় শেখ হসিনার সঙ্গে যুক্ত ছিল। সুতরাং আপনি আলাদা করতে পারবেন না যে, তারা শেখ হাসিনার অনুসারী হওয়ার কারণে তাদের ওপর হামলা হয়েছে, নাকি তারা হিন্দু বলে তাদের ওপর হামলা হয়েছে। কিন্তু তাদের ওপর হামলা হয়েছে, এটা সত্যি। তারপর আমরা সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করি। আমি সবাইকে বলি, আমাদের মতভেদ থাকতে পারে, তার মানে এই নয় যে আমাদের একে অপরকে আক্রমণ করতে হবে।

মার্টিন: আপনি কি মনে করেন যে আপনি জনগণকে প্রতিশোধের পরিবর্তে সংস্কারের দিকে মনোনিবেশ করার পথে ফিরিয়ে আনতে পারবেন?

ইউনূস: প্রতিশোধের সময় মাত্র কয়েক সপ্তাহ ছিল। কিন্তু তারপর স্বাভাবিকতা ফিরে আসতে শুরু করে। তাই আমরা দেশ চালাচ্ছি। বিক্ষোভ এখনো আছে, সেগুলো প্রতিশোধের বিক্ষোভ নয়। বেশিরভাগ বিক্ষোভ তাদের বেতন বৃদ্ধির দাবিতে, তাদের চাকরির দাবিতে, যাদেরকে সরকার আগে বরখাস্ত করেছিল।

তারা বলে, ‘অতীতের সরকার আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে এবং আমরা বিনা কারণে আমাদের চাকরি হারিয়েছি। কারণ আমরা অন্য রাজনৈতিক দলের সদস্য।’ বঞ্চিতরা সবাই তাদের দাবি আদায়ের চেষ্টা করছে। আমরা তাদের বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম– ‘দেখুন এগুলো আপনাদের ১৫ বছরের ক্ষোভ। আমরা ১৫ দিনের মধ্যে এটি সমাধান করতে পারি না। আমাদের কিছু সময় দিন- যাতে আমরা সব ঠিক করতে পারি। আপনারা একটি খুব কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছেন এবং আমাদের এটা এমনভাবে সমাধান করতে হবে, যাতে সেটা স্থায়ী হয়।’

মার্টিন: সময়ের কথা বলছি, সেনাবাহিনী আপনার পেছনে রয়েছে। সামরিক নেতারা বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ১৮ মাস শাসন করতে হবে। বিরোধী দলগুলো তা চায় না। তারা নভেম্বরে নির্বাচন চেয়েছিল। আপনার যা করতে হবে তার জন্য ১৮ মাস যথেষ্ট?

ইউনূস: জনগণ এইরকম সংখ্যাগুলো বলছে; কত মাস, কত বছর লাগবে বলে তারা মনে করে। কেউ কেউ বলে যে এটি দ্রুত করা উচিত, কারণ আপনি যদি দীর্ঘ সময় থাকেন, আপনি অজনপ্রিয় হবেন এবং সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাবে। আবার কেউ কেউ বলেন – ‘না, আপনাকে সংস্কার শেষ করতে হবে। সেজন্য আপনি দীর্ঘ সময় ধরে থাকুন, কারণ আমরা সবকিছু ঠিক না করে বাংলাদেশ ২.০-তে যেতে চাই না।’ এ নিয়ে বিতর্ক চলছে।

মার্টিন: আপনি প্রায় পুরো নাগরিক সমাজকে নতুন করে গড়ে তোলার কথা বলছেন।

ইউনূস: আসলে বাংলাদেশ ২.০ বলতে ঠিক এটাই বোঝায়। আমরা পুরনো চর্চায় ফিরে যেতে চাই না। তা না হলে এত জীবন দেওয়ার মানে কী? এর কোনো মানে থাকবে না, কারণ আমরা যা করেছি (আগের সরকারে) – সবকিছু ধ্বংস করেছি। তাই একটি নতুন দেশ নির্মাণ আমাদের শুরু করতে হবে।

মার্টিন: এটা চ্যালেঞ্জিং, কিন্তু দারুণ, তাই না?

ইউনূস: এটা সত্যিই দারুণ। আপনি হয়ত নেতিবাচক দিকটা দেখছেন। আমি ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছি। আমি বলেছিলাম এই জাতি সবচেয়ে বড় সুযোগ পেয়েছে। পুরো দেশ, দেশের মানুষ আজ একটি বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ- আমাদের পরিবর্তন দরকার।

মার্টিন: আপনার বয়স এখন ৮৪। আমি জানি না আপনি কখনো নিজেকে সরকারপ্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ভেবেছেন কি না। আপনি কি মনে করেন, বাংলাদেশকে যে দেশে পরিণত করার করার আশা আপনি করছেন, সেটা জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারবেন?

ইউনূস: পূর্ণাঙ্গভাবে হয়ত (দেখে যেতে ) পারব না। তবে আমি খুব খুশি হব (এটা জেনে যে) এটা হওয়ার পথে। প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিক থাকবে। সঠিক নীতিতে সব চলবে। তরুণরা বিশ্বকে পরিবর্তন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। দেশে এবং বিশ্বব্যাপী তারা ভূমিকা পালন করবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বললে, আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের ভুক্তভোগী। তবে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আমি সবসময় তরুণদের গুরুত্ব দিই, কারণ তারাই ভবিষ্যৎ গড়বে এবং যেভাবেই হোক তাদের নেতৃত্বের অবস্থানে থাকা উচিত।

কারণ উত্তরাধিকারসূত্রে তারাই এ গ্রহে থাকবে। আপনি বলেছেন যে আমার বয়স ৮৪ বছর। আমার সামনে খুব বেশি সময় নেই, তবে তাদের (তরুণদের) সামনে পুরো জীবন রয়েছে।