ভিয়েনা কনভেনশন কী : দ্বিপক্ষীয় কূটনীতিতে এটির গুরুত্ব

অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় হফবুর্গ প্যালেস যেখানে ১৯৬১ সালে ভিয়েনা চুক্তি সই হয়েছিল।

টুইট ডেস্ক : বাংলাদেশে সম্প্রতি বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের নানা মন্তব্য ও কর্মকান্ড নিয়ে রাজনীতি ও কুটনৈতিক মহলে নানা আলোচনা চলছে।

ভিয়েনা কনভেনশন কী ?
অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় সম্পন্ন হওয়া যেকোন চুক্তিই ভিয়েনা কনভেনশন হিসেবে পরিচিত হতে পারে।

তবে কূটনীতিকদের আচরণ বিষয়ে যে চুক্তিটি ১৯৬১ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে বিভিন্ন দেশের অংশগ্রহণে সই করা হয়েছিল সেটি ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপলোম্যাটিক রিলেশন হিসেবে পরিচিত। এই কনভেনশনে মোট ৫৩টি আর্টিকেল বা ধারা রয়েছে। এই চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল কিছু নিয়ম-নীতি এবং সেগুলো অনুসরণের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়ন।

সেসময় স্বাধীন দেশগুলো ওই চুক্তিতে সই করেছিল। পরে ধাপে ধাপে যেসব দেশ স্বাধীন হতে থাকে তারাও এই চুক্তিতে নিজেদের অন্তর্ভূক্ত করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই চুক্তিতে সই করে ১৯৭৮ সালে।

ভিয়েনা কনভেনশন কেন গুরুত্বপূর্ণ?

বহুকাল আগে থেকেই কূটনীতির অংশ হিসেবে এক দেশের কূটনীকিতরা আরেক দেশে অবস্থান করে আসছে। তবে তারা কী ধরণের সুবিধা পাবেন বা তাদের সাথে কেমন আচরণ করা হবে সে বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে অভিন্ন কোন চুক্তি বা নিয়ম নীতি ছিল না। এই প্রয়োজনীয়তা থেকে পরে ১৯৬১ সালের এপ্রিলে জাতিসংঘের উদ্যোগে ভিয়েনায় এক কনফারেন্সের পর অংশগ্রহণকারী দেশগুলো নিয়ে একটি চুক্তি করা হয়।

ভিয়েনা কনভেনশনে যেসব নিয়ম-নীতি উল্লেখ করা আছে সে অনুযায়ী, কোন দেশে অন্য কোন দেশের কুটনীতিক মিশন বা প্রতিনিধিরা অবস্থান করে থাকে। এই চুক্তির মাধ্যমে অন্য দেশে কূটনীতিকদের বিভিন্ন ধরণের সুবিধা, নিরাপত্তা, বাসস্থান, আইন প্রয়োগসহ নানা বিষয় নিশ্চিত করে থাক গ্রাহক দেশ।

ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী, কূটনীতিক এবং গ্রাহক দেশ আচরণ করে থাকে। যার কারণে এই চুক্তি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয় । কূটনীতিকদের তৎপরতা রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে।  চুক্তিতে বলা হয়েছে, কূটনীতিক সম্পর্ক হবে দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক ঐক্যমতের ভিত্তিতে।

ভিয়েনা কনভেনশনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারা বা আর্টিকেল ৯-এ বলা হয়েছে যে, যেকোন দেশ ওই দেশে নিযুক্ত অন্য দেশের কূটনীতিককে কোন কারণ দর্শানো ছাড়াই ‘পারসোনা নন গ্রাটা’ বা অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করতে পারে। ওই কূটনীতিক সংশ্লিষ্ট দেশে পৌঁছানোর আগেই তাকে অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা করা যায়। একটি দেশের কূটনীতিক মিশনের প্রধানসহ ওই মিশনে কর্মরত যেকোন ব্যক্তিকে অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা করা যেতে পারে।

এক্ষেত্রে নিযুক্ত ওই কূটনীতিককে প্রেরক দেশ হয় বরখাস্ত করবে অথবা ফিরিয়ে নেবে। যদি যথাযথ সময়ে ওই দেশ তাদের কূটনীতিককে ফিরিয়ে নিতে না পারে তাহলে গ্রাহক দেশ ওই কূটনীতিককে তার বিশেষ মর্যাদা ও নিরাপত্তা নাকোচ করতে পারে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এ ধরণের ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে বলে জানান সাবেক একজন পররাষ্ট্রসচিব। দুই দেশই তাদের কূটনীতিককে ‘অগ্রহণযোগ্য’ উল্লেখ করে সাত দিনের মধ্যে দেশে ফিরিয়ে নেয়ার নোটিশ দেয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটতে দেখা যায়। ২০১৯ সালেও কাশ্মির ইস্যুতে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে বরখাস্ত করেছিল পাকিস্তান।

তবে কোন দেশের কূটনীতিককে নিয়ে যদি বাংলাদেশের আপত্তি থাকে তাহলে সেক্ষেত্রে অনানুষ্ঠানিকভাবে তা সংশ্লিষ্ট দেশকে জানানো হয়। আর এভাবেই ওই কূটনীতিককে প্রত্যাহার করা হয়। এই চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়ন।

এছাড়া একটা দেশে অন্য দেশের মিশন কতটা বড় হবে তাও উল্লেখ করা হয়েছে এই চুক্তিতে। এ চুক্তির ১১ ধারায় বলা হয়েছে যে, আলাদা কোন চুক্তি না থাকলে কূটনীতিক মিশনের কাজ বিবেচনায় মিশনের আকার যৌক্তিক হতে হবে।

কূটনীতিকদের অফিস কোথায় হবে সে বিষয়ে চুক্তির ১২নং ধারায় বলা হয়েছে যে, কূটনীতিক মিশন প্রেরণকারী দেশ মিশনের জন্য বরাদ্দকৃত অফিস সীমার বাইরে অন্য কোন জায়গায় কোন অফিস স্থাপন করতে পারবে না।

আর মিশনের অফিস এলাকায় বিদেশি কূটনীতিক মিশন প্রধানের অনুমতি ছাড়া গ্রাহক দেশের সরকারও প্রবেশ করতে পারবে না।

তবে কূটনীতিক মিশনের নিরাপত্তা বিধান করতে হবে গ্রাহক দেশকেই। কূটনীতিক মিশনের প্রাঙ্গন এবং তাদের যানবাহনে তল্লাসি, সেটি ব্যবহার, বাজেয়াপ্ত বা সংযুক্তি কোন কিছুই করা যাবে না।

মিশনের প্রধানকে ওই মিশন এলাকা সম্পর্কিত বিষয়ে সব ধরণের জাতীয়, আঞ্চলিক বা মিউনিসিপালের বকেয়া ও করের বাইরে রাখতে হবে অর্থাৎ তাদের এ সম্পর্কিত কোন কর দিতে হয় না।

কূটনীতি মিশনের দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার এবং কূটনীতিক ও তার পরিবারের সদস্যদের গৃহকর্মে ব্যবহৃত যেকোন পণ্য আনা হলে তা সব ধরণের শুল্ক ও করের বাইরে থাকবে। মারাত্মক কোন অভিযোগ না থাকলে কূটনীতিক এজেন্টদের ব্যাগও তল্লাসি করা যাবে না।

ভিয়েনা কনভেনশনের আর্টিকেল ২৬ এ বলা হয়েছে যে, কূটনীতিক মিশনের সব সদস্য ওই দেশের সবখানে স্বাধীন ও অবাধে চলাচল করতে পারবে। শুধু জাতীয় নিরাপত্তার সাথে সংশ্লিষ্টতার কারণে সংরক্ষিত এলাকায় তাদের প্রবেশ সীমাবদ্ধ হবে। সংরক্ষিত এলাকাতেও আগে থেকে অনুমোদন নিয়ে প্রবেশ করতে পারে কূটনীতিকরা।

এক্ষেত্রে চলতি মাসে, ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ঢাকার শাহীনবাগে নিখোঁজ বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বাড়ি পরিদর্শনের ঘটনা উল্লেখ করা যায়।

ওই এলাকা সংরক্ষিত না হওয়ার কারণে সেখানে রাষ্ট্রদূতের যাওয়ার বিষয়ে এই চুক্তি অনুযায়ী কোন বাধা নেই। একই সাথে তার নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্বও সরকারের উপরই বর্তায়।

এদিকে যোগাযোগের ক্ষেত্রে শুধু চলাচল নয় বরং অবাধে কুরিয়ার ও বার্তা পাঠিয়ে যোগাযোগের বিষয়পিও এই চুক্তির মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে।

চুক্তির ২৭ ধারায় বলা হয়েছে যে, দাপ্তরিক কাজের জন্য মিশনের স্বাধীন যোগাযোগ নিশ্চিত করতে হবে। কুটনৈতিক কুরিয়ার, কোডেড বার্তা পাঠানোসহ যেকোন ধরণের যোগাযোগ করতে পারবে তারা। তবে ওয়্যারলেস ট্রান্সমিটার বসাতে হলে অবশ্যই গ্রাহক দেশের সরকারের অনুমতি লাগবে।

কূটনৈতিক কোন ব্যাগ খোলা বা আটক করা যাবে না। কূটনৈতিক কোন কুরিয়ারও গ্রেফতার বা আটকের আওতায় পড়বে না।

ভিয়েনা কনভেনশনের ২৯ ধারা অনুযায়ী, বিদেশি কূটনীতিকদের আটক বা গ্রেফতার করা যাবে না। তারা গ্রাহক দেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার বাইরে থাকবে। এমনকি তারা কোন ঘটনায় সাক্ষ্য দিতে বাধ্য থাকবেন না।

সবচেয়ে আলোচিত ধারা
বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে ততই বাড়ছে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর পাল্টাপাল্টি তৎপরতা এবং একই সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে নানা ধরণের মন্তব্য করে আলোচনায় আসছেন বিদেশি কূটনীতিকরা।

তবে শুধু গত নির্বাচনই নয় বরং বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক সংকট এলেই তৎপর হতে দেখা যায় বিদেশি কূটনীতিকদের। কূটনীতিকদের নানা মন্তব্যকে সরকারি দল বিভিন্ন সময়ে পাত্তা না দিলেও বিরোধীদলগুলো বরাবরই তাদের মন্তব্যকে সমর্থন করে থাকে।

এমন অবস্থায় সরকারের পক্ষ থেকে ভিয়েনা কনভেনশনের যে ধারার কথা বলা হয় সেটি হচ্ছে চুক্তির ৪১ নম্বর ধারা। এই এক নং উপধারায় বলা হয়েছে যে, যেসব ব্যক্তি অন্য কোন দেশে কূটনীতিকের মর্যাদা ও সুবিধা ভোগ করেন তারা ওই দেশের আইন ও নীতি মেনে চলতে বাধ্য থাকবেন। এছাড়া তারা ওই দেশের অভ্যন্তরীণ কোন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না।

জাপানের রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করার পর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাকে এই উপধারাটি মেনে চলার কথাই বলা হয়েছিল।

এই ধারায় আরো দুটি উপধারা রয়েছে। যেমন ধারার দুই নং উপধারায় বলা হয়েছে যে, কূটনীতিকদের সব ধরনের দাপ্তরিক কাজ যা প্রেরক দেশ কূটনীতিক মিশনের উপর ন্যস্ত করবে তা গ্রাহক দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা এ সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে হতে হবে।

আর তিন নং উপধারায় বলা হয়েছে যে, কূটনীতিকরা তাদের মিশন অফিসের প্রাঙ্গন মিশনের কার্যক্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এমন কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারবেন না। তবে এই উপধারা দুটি তেমন আলোচনায় আসে না। সূত্র : বিবিসি বাংলা