বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী

টুইট ডেস্ক: বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়, যা ২০১১ সালের ৩০শে জুন জাতীয় সংসদে পাস হয় এবং ৩রা জুলাই রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাভ করে। এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে কয়েকটি মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলেছে।

ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার পুনর্বহাল
পঞ্চদশ সংশোধনীর অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার পুনর্বহাল। ১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে ছিল। তবে, ১৯৭৭ সালের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এটি বাতিল করা হয়। পঞ্চদশ সংশোধনী দ্বারা এই ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি পুনরায় সংবিধানে সংযোজন করা হয়, যা রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে।

রাষ্ট্রীয় মূলনীতির পুনঃপ্রতিষ্ঠা
এই সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হয়। এই চারটি নীতি ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূল ভিত্তি ছিল, যা পরবর্তীতে বিভিন্ন সামরিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়েছিল। পঞ্চদশ সংশোধনী এই নীতিগুলোর পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের মূলনীতিকে পুনর্গঠিত করে।

শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতার স্বীকৃতি
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সংবিধানে “জাতির পিতা” হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। এটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা বঙ্গবন্ধুর ভূমিকার প্রতি রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক সম্মান প্রদর্শন করে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল
এই সংশোধনীর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ১৯৯৬ সালে সংবিধানে সংযোজন করা হয়েছিল, যার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সময়ে একটি নিরপেক্ষ সরকার পরিচালনা করা হতো। তবে, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই ব্যবস্থা বাতিল করা হয়, যা দেশজুড়ে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয় এবং রাজনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি করে।

মহিলাদের সংরক্ষিত আসন বৃদ্ধি
পঞ্চদশ সংশোধনী দ্বারা জাতীয় সংসদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ৪৫ থেকে বৃদ্ধি করে ৫০ করা হয়। এই পদক্ষেপটি মহিলাদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীদের প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে সহায়ক হয়েছে।

সংবিধান বহির্ভূত ক্ষমতা দখলের পথে বাধা
সংশোধনীটি সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদের পরে ৭ (ক) ও ৭ (খ) অনুচ্ছেদ সংযোজন করে সংবিধান বহির্ভূত পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের পথ রুদ্ধ করে। এই সংযোজনের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সামরিক শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধ করার প্রচেষ্টা করা হয়।

পাসের প্রক্রিয়া ও বিরোধী দলের ভূমিকা
পঞ্চদশ সংশোধনী বিলটি সেই সময়ের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেন। বিরোধী দল বিএনপির বর্জনের মধ্যে এটি ২৯১-১ ভোটে পাস হয়, যা তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিরোধী দল এবং সরকারের মধ্যে গভীর মতবিরোধের প্রতিফলন ছিল।

পঞ্চদশ সংশোধনী বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং সাংবিধানিক ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন হিসেবে চিহ্নিত হয়। তবে, এর ফলে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নির্বাচন প্রক্রিয়ার উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়ে, যা পরবর্তী সময়ে বিতর্কের জন্ম দেয়।