শহুরে বাসিন্দাদের সামাজিক একতা: নতুন অভিজ্ঞতা

ছবি সংগৃহীত

এম. বি আলম: ৫ আগস্টের পর, ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশি উপস্থিতি কমে গেলে ডাকাতির আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ নিজেদের সুরক্ষার জন্য রাস্তায় নেমে আসে, যা ধীরে ধীরে এক ধরনের সামাজিক মিলনমেলায় পরিণত হয়।

রাতভর পাহারা দিতে গিয়ে শহুরে বাসিন্দারা নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হন এবং একসঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ পান।

মোহাম্মদপুরের সলিমুল্লাহ রোডের বাসিন্দারা প্রথমে তিনজনের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি করেন। সৈয়দ রিদওয়ান হোসেনের নেতৃত্বে এই গ্রুপ দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং এলাকাবাসী রাত জেগে পাহারা দিতে শুরু করে। এই উদ্যোগে অংশগ্রহণকারী স্থানীয়রা একসঙ্গে গল্পগুজব করে, আড্ডা দেয় এবং একে অপরকে সাহায্য করে।

ছবি সংগৃহীত

প্রমিনেন্ট হাউজিংয়ের বাসিন্দারা একই ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এখানে ৩০টি ভবনের প্রায় ৪০০ পরিবারের সদস্যরা রাত জেগে পাহারা দিয়ে নানা সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আয়োজন করেন, যেমন খিচুড়ি ও তেহারি রান্নার আয়োজন। এতে এলাকায় বাস করা নতুন পরিচিতদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং একটি শক্তিশালী সামাজিক বন্ধন তৈরি হয়।

মিরপুরের কাজীপাড়ায়ও একই দৃশ্য দেখা গেছে। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে পাড়ার ছেলেরা রাতে পাহারা দেয় এবং সন্দেহজনক কিছু দেখা গেলে দ্রুত সতর্ক করে। ধানমন্ডিতে, স্থায়ী বাসিন্দারা ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করে এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। তারা নিজেদের উদ্যোগে একটি অ্যাপও তৈরি করে যা সমস্যা সমাধানে দ্রুত সহায়তা প্রদান করে।

বনানীতে, বাসিন্দারা একটি সংগঠন গঠন করে নিয়মিত পাহারা দিচ্ছে। রাতজেগে পাহারা দিয়ে তারা বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উদ্যোগ নিয়েছে, যেমন ট্রাফিক সিস্টেম, নো হর্ন ক্যাম্পেইন, এবং বৃক্ষরোপণ। তাদের এই উদ্যোগে এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে একত্রিত হওয়ার এবং একে অপরকে সাহায্য করার মনোভাব গড়ে উঠেছে।

এই পরিস্থিতি শহুরে জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া কমিউনিটি ভাবনার পুনর্জাগরণ ঘটিয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সুলতানা মোস্তফা খানম বলেন, “সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যূথবদ্ধতা। কমিউনিটি বোধ থেকে “আমি” নয়, “আমরা” ভাবতে শেখা জরুরি। সামাজিক জীব হিসেবে একজন অন্যের পাশে থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যও তা-ই বলে। কিন্তু মানুষ বিচ্ছিন্ন হতে হতে এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছাল যে একটা বড় ঘটনার মাধ্যমে হলেও আবার সেই দলবদ্ধ ভাবনায় ফিরে গেল। এই যে উদ্যোগ গড়ে উঠেছে, সেটাকে টিকিয়ে রাখা জরুরি।”

অধ্যাপক খানমের মতে, এই নতুন অভিজ্ঞতা দীর্ঘমেয়াদীভাবে বজায় রাখতে পাড়া বা ভবনভিত্তিক সংগঠন গঠন করা যেতে পারে। ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপগুলি সচল রাখা, নিয়মিত সামাজিক কার্যক্রম আয়োজন এবং অসাম্প্রদায়িক মনোভাব গড়ে তোলা গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে মানুষের সামাজিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে এবং নিরাপত্তার প্রতি সচেতনতা বাড়বে।

এভাবে, ডাকাতির আতঙ্ক শহুরে সমাজে নতুন একত্রিত হওয়ার সুযোগ এনে দিয়েছে। সাধারণ মানুষ একত্রিত হয়ে নিজস্ব উদ্যোগে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলছে, যা ভবিষ্যতে সমাজে দীর্ঘমেয়াদী ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

কমিউনিটি একতা ধরে রাখার কৌশল

ডাকাতি ও নিরাপত্তার আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে সারাদেশে বিভিন্ন এলাকায় সম্প্রতি যে সামাজিক মিলনমেলা ও কমিউনিটি একতা দেখা গেছে, তা বিশেষ করে শহুরে জীবনকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। এই একতা টিকিয়ে রাখা এবং সম্প্রদায়কে শক্তিশালী করার জন্য কিছু কৌশল প্রণয়ন করা যেতে পারে:

কমিউনিটি সংগঠন গঠন: পাড়া বা ভবনভিত্তিক সংগঠন গঠন করে নিয়মিত সভা, আলোচনা ও পরিকল্পনা করা যেতে পারে। এতে সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় হবে এবং একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ তৈরি হবে।

অনলাইন গ্রুপের কার্যক্রম: ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপগুলি সক্রিয় রাখার মাধ্যমে স্থানীয় খবর, সমস্যা ও সমাধান নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। এই গ্রুপগুলোতে নিয়মিত আপডেট এবং কার্যক্রমের খবর রাখা গুরুত্বপূর্ণ।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আয়োজন: পাড়া বা এলাকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড যেমন ক্রিকেট ম্যাচ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পাড়া মিটিং ইত্যাদি আয়োজন করা যেতে পারে। এসব আয়োজনের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে মেলামেশার সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং কমিউনিটি বোধ বৃদ্ধি পাবে।

নিরাপত্তা ও সহায়তা: সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিয়মিত নিরাপত্তা টহল এবং সহায়তার ব্যবস্থা রাখা উচিত। প্রয়োজনে স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনী বা স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে সমন্বয় করা যেতে পারে।

সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ: জনগণকে নিরাপত্তা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া, যেমন প্রথম চিকিৎসার প্রাথমিক ধারণা, প্রাথমিক সুরক্ষা কৌশল, ইত্যাদি, কমিউনিটি একতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে।

প্রতিবেশী সম্পর্ক উন্নয়ন: প্রতিবেশীদের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। এটি পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমর্থন নিশ্চিত করবে।

সামাজিক দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি: কমিউনিটির সদস্যদের মধ্যে সামাজিক দায়িত্ববোধ সৃষ্টি করতে হবে। সবাই যেন বুঝতে পারে যে, তাদের অংশগ্রহণ এবং সহযোগিতা কমিউনিটি শক্তিশালী করতে সহায়ক।

নিয়মিত কার্যক্রম ও ফিডব্যাক: নিয়মিত ভিত্তিতে কমিউনিটির কার্যক্রম পর্যালোচনা করা এবং সদস্যদের ফিডব্যাক নেয়া উচিত। এতে সমস্যা সমাধান সহজ হবে এবং প্রয়োজনীয় পরিবর্তন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।

কমিউনিটি একতা দীর্ঘমেয়াদীভাবে বজায় রাখতে এই কৌশলগুলো কার্যকরী হতে পারে। এটি শুধুমাত্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে না, বরং সামাজিক সংহতি ও সহযোগিতার মাধ্যমে একটি শক্তিশালী ও সুসংহত সমাজ গঠনে সহায়ক হবে।