অসহযোগের সংঘাতে ১৪ পুলিশসহ নিহত ৬২

টুইট ডেস্ক : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে এক দফা দাবিতে সর্বাত্মক অসহযোগের প্রথম দিন দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘাত ও প্রাণহানির খবর আসছে। রাত আটটায় সর্বশেষ তথ্য মতে ৬০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

এর মধ্যে, সিরাজগঞ্জে ১৩ পুলিশসহ ২২ জন, ঢাকায় সংঘর্ষে ৬ জন, নরসিংদীতে সংঘর্ষে ৬ জন, ফেনীতে ৫ জন, রংপুরে যুবলীগ কর্মীসহ ৩ জন, কিশোরগঞ্জে ৩ জন, শেরপুরে ৩, পাবনায় ৩ জন, মুন্সীগঞ্জে ২ জন, মাগুরায় ছাত্রদল নেতাসহ ২ জন, কুমিল্লায় ২ জন, সিলেটের গোলাপগঞ্জে ২ জন, বরিশাল সদরে ১ আওয়ামী লীগ নেতা, সাভারে ১ জন ও জয়পুরহাটে ১ জনের মৃত্যু হয়েছে।

১৩ পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা

সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় ১৩ পুলিশ সদস্য হত্যার শিকার হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাহিনীর সদর দপ্তরের জনসংযোগ বিভাগের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা কামরুল আহসান।

পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি বিজয় বসাক বলেন, “আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে এসে এনায়েতপুর থানায় হামলা ও ভাঙচুর চালায়। একপর্যায়ে তারা থানায় আগুন দেয় এবং সেখানে থাকা পুলিশ সদস্যদের পিটিয়ে হত্যা করে।”

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা ১১টার দিকে আন্দোলনকারী থানার দক্ষিণে জমায়েত হয়। সেখানে ছাত্রদের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীসহ স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার লোকজন ছিলেন। জমায়েত থেকে মিছিল নিয়ে আন্দোলনকারীরা থানার দিকে যান। থানার সামনে আসার পর পুলিশ তাদের বাধা দেয়। তখন দুই পক্ষের মধ্যে ঘণ্টাখানেক ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।

আন্দোলনকারীরা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করলে জবাবে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও গুলি ছোঁড়ে। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা থানার ভেতরে ঢুকে পড়ে আগুন দেয়। এরপর পুলিশ সদস্যদের ধরে ধরে পিটিয়ে হত্যা করে।

নরসিংদীতে আ.লীগের ৬ জনকে পিটিয়ে হত্যা

নরসিংদী শহরের মাধবদী পৌরসভা মোড়ে আওয়ামী লীগের ছয় নেতাকর্মীকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যার খবর পাওয়া গেছে। তারা হলেন- সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেনের ছোট ভাই দেলোয়ার হোসেন, সদর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি মনির হোসেন ভুঁইয়া, সদর উপজেলার চরদীঘলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন, ছাত্রলীগকর্মী জলিল, সজীব ও মোক্তার।

উপজেলা চেয়ারম্যান আনোয়ারের খালাত ভাই আল আমিন বিকালে বলেন, “আমার আপন খালাত ভাই দেলোয়ার হোসেনকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করেছে। আরও কয়েকজনকে ওরা হত্যা করেছে।”

সদর উপজেলা ও মাধবদী শহর আওয়ামী লীগের দুই নেতা বাকি চারজনের মৃত্যুর খবর জানিয়ে বলেছেন, লাশগুলো মাধবদী শহরের বড় মসজিদের অজুঘরের পাশের রাস্তায় ফেলে রাখা হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আন্দোলনকারীরা সকাল থেকেই ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছিলেন। হঠাৎ করেই তারা মিছিল নিয়ে শহরের ভিতরে প্রবেশ করতে থাকেন। মাধবদীতে আগে থেকেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অবস্থান নিয়েছিলেন।

একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দেয়। ধাওয়া খেয়ে আন্দোলনকারীরা প্রথমে সরে যায়। কিন্তু পরে তারা আরও লোক নিয়ে এসে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ধাওয়া দেয়। দীর্ঘক্ষণ ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পিছু হটে। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের অন্যরা সরে যেতে পারলেও ছয়জন আটকা পড়েন। তাদেরকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা হয়।

সিলেটে সংঘর্ষে নিহত ২

রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গোলাপগঞ্জ উপজেলার সদরের ঢাকা দক্ষিণ বাজার এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাঁধে। তাতে দুজন মারা যান।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সুদর্শন সেন বলেন, হাসপাতালে দুইজনের মৃতদেহ আনা হয়েছিল। মৃতদের মধ্যে একজনের নাম পাওয়া গেছে। তিনি হলেন উপজেলার ধারাবাহর গ্রামের মকবুল আলীর ছেলে ব্যবসায়ী তাজ উদ্দিন (৪৩)।

ফেনীতে সংঘর্ষে নিহত ৫ জন

ছাত্র-জনতার সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হয়েছে। রোববার দুপুরের মধ্যে শহরের শহীদ শহীদুল্লাহ সড়ক ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মহীপাল মোড় এলাকায় সংঘর্ষে এসব নিহতের ঘটনা ঘটে।

ফেনী আড়াইশ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) আসিফ ইকবাল বলেন, “দুপুর থেকে আমাদের এখানে পাঁচটি লাশ এসেছে। এসব লাশ মর্গে রাখা হয়েছে।”

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা শহরে বিক্ষোভ শুরু করে। তাদের সাধারণ মানুষকেও দেখা যায়। এ সময় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাও অবস্থান নেন। তাদের অনেককে সশস্ত্র অবস্থায়ও দেখা যায়। এর মধ্যেই উভয়পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হলে গোটা এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। তার মধ্যেই পাঁচজনের মৃত্যুর সংবাদ আসে।

পাবনায় গুলিতে নিহত ৩

আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ চলাকালে সংঘর্ষের মধ্যে গুলি খেয়ে তিনজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় আরও ৩৪ জন গুলিবিদ্ধসহ অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। রোববার দুপুরে শহরের ট্রাফিক মোড়ে গুলি চালানোর ঘটনা ঘটে।

বিক্ষোভকারী একাধিক শিক্ষার্থী জানান, বেলা ১১টার দিকে পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের মেইন গেইটে এক দফা দাবিতে কয়েক হাজার আন্দোলনকারী জড়ো হন। সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান নেওয়ার পর বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে তারা শহরের ট্রাফিক মোড় এলাকায় পৌঁছে আব্দুর হামিদ সড়কে প্রবেশের চেষ্টা করেন। এ সময় পুলিশের বাধায় সেখানেই অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা এবং বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন তারা।

একপর্যায়ে বেলা ১২টার দিকে ট্রাফিক মোড় এলাকায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কর্মীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। এ সময় একদল ব্যক্তি আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায়। এতে ৩৭ জন গুলিবিদ্ধ হন। পরে গুলিবিদ্ধদের উদ্ধার করে পাবনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তিনজনকে মৃত ঘোষণা করেন।

নিহতরা হলেন- চর বলরামপুরের বাসিন্দা পাবনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম (২১), হাজিরহাট ব্রজনাথপুরের বাসিন্দা মাহবুবুর রহমান (২২) ও এডওয়ার্ড কলেজের শিক্ষার্থী ফাহিম হোসেন (১৭)।

হাসপাতালের সহকারী পরিচালক রফিকুল হাসান বলেন, “গুলিবিদ্ধ দুইজনকে হাসপাতালে আনার পর তারা মারা যান। আর একজনকে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছিল। গুলিবিদ্ধ আরও ৩৪ জনের চিকিৎসা চলছে। এছাড়া আরও অনেকেই আহত হয়েছে।”

রংপুরে যুবলীগ কর্মীসহ ৩ জন নিহত

রোববার দুপুর থেকেই মহানগরীর জাহাজ কোম্পানি মোড়, সিটি বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীরা জড়ো হন। তাদের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ তাদের অন্যান্য সংগঠনের নেতাকর্মীরাও মিছিল নিয়ে জড়ো হতে থাকেন। একপর্যায়ে দুপক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। দুপুর ১২টা থেকে ১টার মধ্যে তা আশপাশের এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় যুবলীগকর্মীসহ তিনজন নিহত হন।

নিহতরা হলেন- রংপুর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর হারাধন রায় হারা, যুবলীগকর্মী মাসুম মিয়া (৩১) ও নগরীর গোড়াপীপাড়ার বাসিন্দা খাইরুল (৩০)।

মাগুরায় নিহত ২

রোববার বেলা ১১টার দিকে শহরের ঢাকা রোডে পুলিশ ও বিএনপি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এই সংঘর্ষের পর এক ছাত্রদল নেতার গুলিবিদ্ধ লাশ নেওয়া হয়েছে হাসপাতালে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকালে পারনান্দুয়ালী এলাকা থেকে বিএনপি নেতাকর্মীরা একটি মিছিল নিয়ে শহরে ঢুকতে গেলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়।

এ সময় বিএনপি নেতাকর্মীরা পুলিশের উপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে, পুলিশও তাদের ধাওয়া করে রাবার বুলেট ও গুলি নিক্ষেপ করে। তখন জেলা ছাত্রদলের যুগ্ম-সম্পাদক মেহেদী হাসান রাব্বী পুলিশের গুলিতে নিহত হন বলে দাবি করেছেন জেলা ছাত্রদলের সভাপতি আব্দুর রহিম। তিনি বলেন, “পুলিশের গুলিতে রাব্বি নিহত হয়েছে। তার বুকে গুলি লেগেছে।”

মাগুরা ২৫০ শয্যা হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্মী আজিজুর রহমান বলেন, বেলা ১২টার দিকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় একজনকে হাসপাতালে আনা হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

জরুরি বিভাগের চিকিৎসক অমর প্রসাদ বিশ্বাস জানান, তিন পুলিশ সদস্যসহ আহত ১০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। দুপুরে শহরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ফরহাদ হোসেন নামের আরেক ব্যক্তি। তিনি শ্রীপুর উপজেলার রায়নগর গ্রামের গোলাম রসুলের ছেলে।

মুন্সীগঞ্জে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ২

মুন্সীগঞ্জ শহরে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ ও পুলিশের সংঘর্ষে দুইজন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। রোববার শহরের সুপার মার্কেট এলাকায় এই সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় আহত হয়েছেন অন্তত ৪০ জন।

মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মো. আবু হেনা মোহাম্মদ জামাল বলেন, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দুইজনকে তাদের হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। পরীক্ষা করে তাদের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।

আমাদের প্রতিনিধি ফারহানা মির্জা জানান, নিহতদের দুইজনই পুরুষ। তাদের বয়স ২২ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে।