যে আসক্তি বিপদ ডেকে আনছে

টুইট ডেস্ক : বর্তমানে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারী অধিকাংশ শিশু পর্নোগ্রাফি দেখছে। একপর্যায়ে তারা আসক্ত হয়ে পড়ছে। ফল হিসেবে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে শিশু-কিশোরদের মধ্যে ধর্ষণ, ইভটিজিং ও যৌন নির্যাতনের প্রবণতা।

শিশুবিশেষজ্ঞরা বলছেন, পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত শিশুদের সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ আসক্তি শিশু-কিশোরদের শারীরিকভাবে দুর্বল করে দিচ্ছে। এতে তাদের কর্মক্ষমতা কমছে। পড়াশোনায়ও অনীহা তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি তারা নানা ধরনের যৌনবিষয়ক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। আসক্তির কারণে তরুণদের মধ্যে নৈতিক অধঃপতন হচ্ছে। ফলে আমরা দেখছি, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা এখন ধর্ষণ মামলার আসামি হচ্ছে।

গবেষণার ফল কি বলছে

২০২৩ সালে শিশু সহিংসতা নিয়ে একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে বেসরকারি সংস্থা- ইনসিডিন বাংলাদেশ ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের অধিকাংশ শিশুই তাদের বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়র মাধ্যমে পর্ন দেখা শুরু করে এবং পরে আসক্ত হয়।

এতে বলা হয়েছে, দেশের ৩৪ শতাংশ শিশু পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত। তাদের মধ্যে ৭৫ শতাংশই মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করে পর্নোগ্রাফি দেখে। পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত ২৬ শতাংশ মেয়ে শিশু তাদের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে এসব দেখে। ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ অনাত্মীয় বা পরিবারের বাইরের লোকজনের সঙ্গে দেখে। পর্নোগ্রাফি দেখা শিশুদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪৯ দশমিক ৪ শতাংশ দেখে বন্ধু অথবা আত্মীয়-স্বজনের বাসায়। ৩২.৩ শতাংশ দেখে নিজেদের বাসায়। ৫৯ দশমিক ২ শতাংশ শিশু তাদের বন্ধু-বান্ধবের মাধ্যমে প্রথম পর্ন দেখে। বাকিরা আত্মীয়-স্বজন, অপরিচিত এবং নিজ থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেখে।

সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ার্নেস ফাউন্ডেশনের গবেষণা বলছে, গত ছয় বছরে শিশুদের সাইবার অপরাধের শিকার হওয়ার হার ব্যাপক বাড়ছে, যা উদ্বেগজনক। ২০২৩ সালের জরিপে ভুক্তভোগীদের ১৪ দশমিক ৮২ শতাংশের বয়সই ১৮ বছরের নিচে, যা ২০১৮ সালের জরিপের তুলনায় ১৪০ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে।

শিশুদের মধ্যে কেন এ আসক্তি

সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, ১৮ বছরের নিচের শিশু-কিশোররা মূলত দুটি কারণে এ ধরনের অনলাইন সেক্সুয়াল অ্যাক্টিভিটিজ বা পর্নোগ্রাফির সঙ্গে জড়িত হচ্ছে। প্রথমত, বয়সগত কারণে হরমোনের পরিবর্তন; অপরটি হচ্ছে বন্ধু-বান্ধবের প্রভাব। এছাড়া, আগে পর্নোগ্রাফির কনটেন্টগুলো সবাই গোপনীয়তার সঙ্গে উপভোগ করত। এখন এগুলো খোলা মেলাভাবে উপভোগ করা হয়। মোবাইলে বা ল্যাপটপে ইন্টারনেট ব্যবহার করলে অনেক সময় অনিচ্ছাকৃতভাবেও চলে আসে কনটেন্টগুলো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং সমাজ ও অপরাধবিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, শারীরিক পরিবর্তন এবং সঙ্গগত (বন্ধু-বান্ধব) কারণে শিশু-কিশোররা পর্নোগ্রাফি দেখায় আসক্ত হচ্ছে। এগুলো দেখে একপর্যায়ে তাদের যৌন আকাঙ্ক্ষা তৈরি হচ্ছে। তখন তারা বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক করে যৌন আকাঙ্ক্ষা মেটানোর চেষ্টা করছে। যখন তারা ব্যর্থ হচ্ছে তখন জোরপূর্বক চেষ্টা করছে। ধর্ষণ, ইভটিজিং, যৌন নিপীড়নের মতো কাজে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। এগুলো করতে না পারলে টাকার বিনিময়ে আকাঙ্ক্ষা মেটানোর চেষ্টা করছে। ফলে একদিকে যেমন তাদের নৈতিক অবক্ষয় হচ্ছে, অন্যদিকে পড়াশোনায় অনীহা তৈরি হচ্ছে। মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত হচ্ছে তারা।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ইউটিউব বা টিকটকে অনেক প্রি-সেক্সুয়াল কনটেন্ট দেখা যায়। এসব কনটেন্টে নগ্নতা না থাকলেও এগুলো যৌন সুড়সুড়ি বা যৌন উন্মাদনা তৈরি করে। নগ্ন কনটেন্টগুলোর বিষয়ে নানা রকম উদ্যোগ নেওয়া হলেও এগুলোর বিরুদ্ধে কেউ কোনো উদ্যোগ নেয় না। পর্নোগ্রাফি দেখে একপর্যায়ে তাদের যৌন আকাঙ্ক্ষা তৈরি হচ্ছে। তারা বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক করে যৌন আকাঙ্ক্ষা মেটানোর চেষ্টা করছে। যখন ব্যর্থ হচ্ছে তখন জোরপূর্বক চেষ্টা করছে। ধর্ষণ, ইভটিজিং, যৌন নিপীড়নের মতো কাজে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। এগুলো করতে না পারলে টাকার বিনিময়ে আকাঙ্ক্ষা মেটানোর চেষ্টা করছে।

স্যার সলিমুল্ল্যাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের পেড্রিয়াটিক সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক শেখ জাহিদ বখস বলেন, ‘পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত ছেলে ও মেয়েরা বাসায় পরিবারের অনেকের সঙ্গে মিশতে চায় না, একা থাকতে পছন্দ করে। একপর্যায়ে মানসিক রোগে ভোগে। মেজাজ খিটখিটে হয়। এছাড়াও, আসক্ত অনেকের ক্ষেত্রে বিশেষ করে ছেলেদের বিয়ের পর সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা কমে যেতে পারে। এক কথায় বলতে গেলে, এ আসক্তির পরিণতি মাদক থেকেও ভয়াবহ।’

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মানসিক রোগবিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, পর্নোগ্রাফি শিশুদের ভেতরে বিকৃত মানসিকতা তৈরি করে। যৌনবিষয়ক একটি বিকৃত চিন্তা ও ধারণা তৈরি করে। বাংলাদেশে তেমন যৌনাচারের শিক্ষাব্যবস্থা নেই, তাই শিশুরা ভিডিওতে যা দেখে, স্বাভাবিক জীবনকেও সেটা মনে করে। যখন তারা এগুলো দেখে তাদের মধ্যে একটি সেক্সুয়াল ক্রাইম করার প্রবণতা বেড়ে যায়। অনেক সময় তারা না জেনেই নিজেদের এসব ক্রাইমের দিকে ঠেলে দেয়।